পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে ○ ○ > কাজ করে বলে ব্যস্তবাগীশ লোকেরা তার চেয়ে দাওয়াইখানার জয়েন্ট স্টক কোম্পানিকে ঢের বড়ো বলে মনে করে- এমন-কি, তার জনো স্বাস্থ্য বিসর্জন করতেও রাজি হয় । সম্মানের জন্যে মানুষ শিরোপা প্রার্থনা করে, এবং তার প্রয়োজনও থাকতে পারে, কিন্তু শিরোপা দ্বারা মানুষের মাথা বড়ো হয় না। আসল গৌরবের বার্তা মস্তিষ্কেই আছে, শিরোপায় নেই ; প্ৰাণের সৃষ্টিঘরে আছে, দোকানের কারখানাঘরে নেই। বসন্তু বাংলার চিত্ত-উপবনে প্ৰাণদেবতার দাক্ষিণ্য নিয়ে এসে পৌচেছে, এ হল একেবারে ভিতরকার খবর, খবরের কাগজের খবর নয় ; এর ঘোষণার ভার কবিদের উপর । আমি আজ সেই কবির কর্তব্য করতে এসেছি ; আমি বলতে এসেছি, অহল্যাপাষাণীর উপর রামচন্দ্রের পদস্পর্শ হয়েছে- এই দৃশ্য দেখা গেছে বাংলাসাহিত্যে, এইটেই আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো আশার কথা। আজ বাংলা হতে দূরেও বাঙালিদের হৃদয়ক্ষেত্রে সেই আশা ও পুলকের সঞ্চার হােক। খুব বেশি দিনের কথা নয়, বড়ো জোর ষাট বছরের মধ্যে বাংলাসাহিত্য কথায় ছন্দে গানে ভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে । এই শক্তির এইখানেই শেষ নয় । আমাদের মনে আশা ও বিশ্বাসের সঞ্চার হোক । আমরা এই শক্তিকে চিরজীবিনী করি । যেখানেই মানবশক্তি ভাষায় ও সাহিত্যে প্ৰকাশমান হয়েছে সেইখানেই মানুষ অমরতা লাভ করেছে ও সর্বমানবসভায় আপন আসন ও বরমাল্য পেয়েছে। অল্প কয়েকদিন পূর্বেই মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেখানকার অধ্যাপক ডাক্তার অটাে আমাকে লিখেছেন যে, তারা শান্তিনিকেতনে বাংলাসাহিত্যের চর্চা করবার জন্য একজন অধ্যাপককে পাঠাতে চান । তিনি এখান থেকে শিক্ষালাভ করে ফিরে গেলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার ‘চেয়ার সৃষ্টি করা হবে । এই ইচ্ছা দশ বছর আগে কোনো বিদেশীর মনে জাগে নি । আজ বঙ্গবাণীর উৎস খুলে গেল। যারা তার ধারার সন্ধানে ছুটে এল তাদের পরিবেশনের ভার আমাদের উপর রয়েছে । আমাদের আশা ও সাহস থাকলে এই ব্যাপারটি নিশ্চয়ই ঘটতে পারবে । আমরা সকলে মিলিত হয়ে সেই ভাবীকালের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকব। এই অধ্যবসায়ে বাংলা যদি বিশেষ গৌরব অর্জন করে সে কি সমগ্ৰ ভারতবর্ষের সামগ্ৰী হবে না । গাছের যে-শাখাতেই ফুল ফুটুক সে কি সকল গাছের নয়। অরণ্যের যে-বনস্পতিটি ফুলে ফলে ভরে উঠল। যদি তারই উদ্দেশে মধুকরেরা ছুটে আসে। তবে সমগ্র অরণ্য তাদের সমাদরে বরণ করে লয়। আজ বাংলার প্রাঙ্গণেই যদি অতিথিদের সমাগম হয়ে থাকে। তবে তাতে ক্ষতি কী । তারা যে ভারতবর্ষেরই ক্ষেত্রে এসে মিলিত হয়েছেন, ভারতবাসীদের তা মানতে হবে । বঙ্গসাহিত্য আজ পরম শ্রদ্ধায় সেই মধুব্রতদের আহবান করুক । Cejši sobo সভাপতির শেষ বক্তব্য আমাদের দৈহিক প্রকৃতিতে আমরা দেখতে পাই যে, তার কতকগুলি বিশেষ মর্মস্থান আছে- যেমন, প্ৰাণের যে-প্রবাহ রক্তচলাচলের সহযোগে অঙ্গের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয় তার মর্মস্থান হচ্ছে হৎপিণ্ড ; আর, ইন্দ্ৰিয়বোধের যে-ধারা স্নায়ুতন্তু অবলম্বন করে দেহে বিস্তৃত হয়েছে, তার কেন্দ্র হচ্ছে মস্তিষ্ক তেমনি প্ৰত্যেক দেশের চিত্তে যে জ্ঞান ও ভাবের ধারা প্রবহমান, তার এক-একটি মর্মস্থান আপনিই সৃষ্ট হয়ে থাকে । পশ্চিম-মহাদেশে আমরা দেখতে পাই যে, ফ্রান্সের চিত্তের কেন্দ্ৰভূমি প্যারিস, ইতালির রোম, ও প্রাচীন গ্ৰীসের এথেন্স। হিন্দু-ভারতবর্ষের ইতিহাসেও তেমনি দূরে দূরে যত বিদ্যার উৎস উৎসারিত হয়েছে তার ধারা সর্বদাই কোনো-না-কোনো উপলক্ষে কাশীতে এসে মিলিত হয়েছে। ইতিপূর্বে রাধাকুমুদবাবু তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, বৈদিক যুগে কাশী ব্ৰহ্মবিদ্যার আলোচনার, কেন্দ্র ছিল, তার