পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gł RO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী নষ্ট না করি, তপোভঙ্গ যেন আমাদের না হয় । মানবজীবনকে বড়ো করে দেখার শক্তি সব চাইতে বড়ো শক্তি । সেই শক্তিকে আমরা যেন রক্ষা করি । সংকীর্ণতা প্ৰাদেশিকতার দ্বারা সে-শক্তিকে আমরা খর্ব করব না । এজন্যে আমাদের অনেক লড়াই করতে হবে । সে লড়াই করতে না পারলে আমাদের মৃত্যু নিশ্চয় । যুদ্ধের পথেই আমরা বীৰ্য পাব। যে-আত্মসংযমের দ্বারা মানুষ বড়ো শক্তি পেয়েছে তাকে অবিশ্বাস করে যদি বলি, সেটা পুরানো ফ্যাশন, এখন তার সময় গেছে, তা হলে আমাদের মৃত্যু ৷ যে-ফল এখনো পাকবার সময় হয় নি তার ভিতর পোকা ঢুকেছে, এই আক্ষেপ মনের ভিতর যখন জাগে তখন সেটাকে কেউ যেন ব্যক্তিগত কলহের কথা বলে না। মনে করেন । যে-সমস্ত লেখা সমাজের কাছে তিরস্কৃত হতে পারত যখন দেখি তাও সম্ভব হয়েছে, তখন নিঃসন্দেহে বুঝতে হবে, বাতাসে কিছু ঘোরতর বিষসঞ্চার হয়েছে। এই মনের আক্ষেপ নিয়ে হয়তো কিছু বলে থাকব । বেদনা কিছু ছিল দেশের দিকে, কালের দিকে, সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে । যদি কেউ মনে করেন, এই বেদনা প্ৰকাশের অধিকার আমাদের নাই, অসংযতভাবে তারা যা বলেন সেটা এখনকার ডেমোক্রাটিক সাহিত্যে সত্য বলে গ্ৰহণ করতে হবে, তা হলে বলতে হবে, তাদের মতের সঙ্গে আমার মতের মিল নেই। যদি কেউ বলেন, আমরা সে দলের নই, আমি খুশি হব। মানুষের জন্য, দেশের জন্য, সমাজের জন্য র্যারা কাজ করেন, ত্যাগের ভিতর দিয়ে, সংযমের ভিতর দিয়েই করেন । কেউ যেন কখনো না বলেন, উন্মত্ততার দ্বারা পৃথিবীর উপকার করব । যাকে শ্রদ্ধা বলে তা সৃষ্টি করে, অশ্রদ্ধা নষ্ট করে । যদি বলি, আমি বড়োকে শ্রদ্ধা করি না, তা হলে শুধু যে বড়োকে আঘাত করি তা নয়, সৃষ্টির শক্তিকে একেবারে নষ্ট করি, সেটা আমাদের পতনের কারণ হয় । যারা বিজয়ী হয়েছে তারা শ্রদ্ধার উপর দৃঢ়ভাবে দাড়িয়ে জয় করেছে। বড়ো বড়ো যুদ্ধে যে-সকল সেনাপতিরা জিতেছেন তারা হরতে হারিতেও বলেছেন “আমরা জিতেছি, কখনো হারকে স্বীকার করতে চান নি । সেটা উপস্থিত তথ্যের বিরোধী হতে পারে- । হয়তো হেরেছিলেন । কিন্তু, যেহেতু তারা নিজেকে শ্রদ্ধা করেছেন, তার দ্বারা হারের ভিতর দিয়ে জয়কে সৃষ্টি করেছেন । শ্রদ্ধার দ্বারা সমস্ত জাতির জয়সম্পদকে সৃষ্টি করা যায় । যখন দেখি, জাতির মনে অশ্রদ্ধা আসন পেতে মহৎকে অট্টহাসির দ্বারা বিদ্রুপ করতে থাকে, তখন সব-চাইতে বেশি আশঙ্কা হয়, তখন হতাশ হয়ে বলতে হয়, পরাভবের সময় এল। আমাদের সিদ্ধি সে তো দূরে রয়েছে, কিন্তু তার অগ্রগামী দূত যে-শ্রদ্ধা সেও যদি না থাকে তা হলে তার চেয়ে এমনতরো সর্বনাশ আর কিছু হতে পারে না । আমার নিজের লেখাতে যেটা বিকৃত সেটার নজির দেখাতে পারেন, অসম্ভব কিছু নয় । দীর্ঘকালের লেখার ভিতরে কখনো কলুষ লাগে নি, এ কথা বলতে পারব না। যদি বলি, যা-কিছু লিখেছি সমস্ত শ্রদ্ধেয়, সমস্ত ভালো, অতবড়ো দাম্ভিকতা আর-কিছু হতে পারে না । অনেক রকমের অনেক লেখার মধ্য থেকে খুঁটে খুঁটে যেগুলি নিজের পক্ষ সমর্থন করে সেগুলিই যদি গ্ৰহণ করি তবে তার দ্বারা শেষ কথা বা সম্পূর্ণ কথা বলা হবে না। আজকের সভায় ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, নিন্দা-প্ৰশংসার কথা নয়- ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে যারা সাহিত্যের সত্যকে মনের ভিতর দেখতে পেয়েছেন তারা আপনাদের মনের কথা বলবেন, এই বিশ্বাসেই এই সভা আহবান করেছিলাম। আমি আশা করেছিলাম, সাহিত্য সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মত র্যাদের আছে তারা সেটা সুস্পষ্ট করে ব্যক্ত করবেন । কোন নীতির ভিত্তির উপর সাহিত্য রচিত হয়ে থাকে, কোন সাহিতা মানুয্যের কাছে চিরকালের গৌরব পাওয়ার যোগ্য, সেই সম্বন্ধে কারও কিছু বিশেষ ভাবে বলবার থাকে সেইটাই বলবেন, এই সংকল্প করেই আমি আপনাদের ডেকেছি। আমি কখনো মনে করি নি, আমার পক্ষের কথা বলে সকলের কথাকে চাপা দেব । আমার নিবেদন এই যে, আপনারা আমার উপর রাগ না করে আপনাদের মত সভায় ব্যক্ত করুন । আমার যেটা মত সেটা আমারই মত । যদি বলেন, এ মত সেকেলে, পুরোনো, তা হলে সেটাকে অনিবাৰ্য বলে মেনে নিতে রাজি আছি । যে-মত নিয়ে কাজ করেছি, লিখেছি, সেটা সত্য জেনেই করেছি, তাকে যদি মূঢ়তা বলে বিচার করেন করুন । আমার সাফাই জবাব থাকে দিতে চেষ্টা করব ; আমরা এতদিন যা ভেবে এসেছি সেটা