পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GłR8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পঞ্চাশোধৰ্ম পঞ্চাশ বছরের পরে সংসার থেকে সরে থাকার জন্য মনু আদেশ করেছেন । যাকে তিনি পঞ্চাশ বলেছেন, সে একটা গণিতের অঙ্ক নয়, তার সম্বন্ধে ঠিক ঘড়িধরা হিসাব চলে না। ভাবখানা এই যে, নিরন্তরীপরিণতি জীবনের ধর্ম নয়। শক্তির পরিব্যাপ্তি কিছুদিন পর্যন্ত এগিয়ে চলে, তার পরে পিছিয়ে আসে । সেই সময়টাতেই কর্মে যতি দেবার সময় ; না। যদি মানা যায়, তবে জীবনযাত্রার ছন্দোভঙ্গ হয় । জীবনের ফসল সংসারকে দিয়ে যেতে হবে । কিন্তু যেমন-তেমন করে দিলেই হল না । শাস্ত্ৰ বলে, “শ্রদ্ধয়া দেয়াম ; যা আমাদের শ্রেষ্ঠ তাই দেওয়াই শ্রদ্ধার দান- সে না কুঁড়ির দান, না ঝরা ফুলের । ভরা ইন্দারায় নির্মল জলের দক্ষিণ্য, সেই পূর্ণতার সুযোগেই জলদানের পুণ্য ; দৈন্য যখন এসে তাকে তলার দিকে নিয়ে যায়, তখন যতই টানাটানি করি ততই ঘোলা হয়ে ওঠে । তখন এ কথা যেন প্ৰসন্ন মনে বলতে পারি যে, থাক, আর কােজ নেই । বর্তমান কালে আমরা বড়োবেশি লোকচক্ষুর গোচরে । আর পঞ্চাশ বছর পূর্বেও এত বেশি দৃষ্টির ভিড় ছিল না । তখন আপন মনে কাজ করার অবকাশ ছিল, অর্থাৎ কাজ না-করাটাও আপন মনের উপরই নির্ভর করত, হাজার লোকের কাছে তার জবাবদিহি ছিল না । মনু যে “বনং ব্ৰজেৎ' বলেন, সেই ছুটি নেবার বনটা হাতের কাছেই ছিল ; আজ সেটা আগাগোড়া নির্মূল। আজ মন যখন বলে ‘আর কােজ নেই, বহু দৃষ্টির অনুশাসন দরজা আগলে বলে “কাজ আছে বৈকি - পালাবার পথ থাকে না। জনসভায় ঠাসা ভিড়ের মধ্যে এসে পড়া গেছে ; পাশ কাটিয়ে চুপিচুপি সরে পড়বার জো নেই। ঘরজোড়া বহু চক্ষুর ভৎসনা এড়াবে, কার সাধ্য ? চারি দিক থেকে রব ওঠে, “যাও কোথায় এরই মধ্যে ? ভগবান মনুর কণ্ঠ সম্পূৰ্ণ চাপা পড়ে যায়। যে কাজটা নিজের অন্তরের ফরম্যাশে তা নিয়ে বাহিরের কাছে কোনো দায় নেই। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যক্রমে সাহিত্যে বাহিরের দাবি দুর্বাের । যে-মাছ জলে আছে তার কোনো বালাই নেই, যে-মাছ হাটে এসেছে তাকে নিয়েই মেছোবাজার । সত্য করেই হােক, ছল করেই হােক, রাগের বঁাজে হােক, অনুরাগের ব্যথায় হােক, যোগ্য ব্যক্তিই হােক, অযোগ্য ব্যক্তিই হােক, যে-সে যখন-তখন যাকে-তাকে বলে উঠতে পারে, “তোমার রসের জোগান কমে আসছে, তোমার রূপের ডালিতে রঙের রেশ ফিকে হয়ে এল ।” তর্ক করতে যাওয়া বৃথা ; কারণ শেষ যুক্তিটা এই যে, “আমার পছন্দ-মাফিক হচ্ছে না।” “তোমার পছন্দের বিকার হতে পারে, তোমার সুরুচির অভাব থাকতে পারে। এ কথা বলে লাভ নেই। কেননা, এ হল রুচির বিরুদ্ধে রুচির তর্ক ; এ তর্কে দেশকালপত্রবিশেষে কটুভাষার পঙ্কিলতা মথিত হয়ে ওঠে, এমন অবস্থায় শাস্তির কটুত্ব কমাবার জন্যে সবিনয় দীনতা স্বীকার করে বলা ভালো যে, স্বভাবের নিয়মেই শক্তির হ্রাস ; অতএব শক্তির পূর্ণতাকালে যে-উপহার দেওয়া গেছে তারই কথা মনে রেখে, অনিবাৰ্য অভাবের সময়কার ক্রটি ক্ষমা করাই সীেজন্যের লক্ষণ ।। শ্রাবণের মেঘ আশ্বিনের আকাশে বিদায় নেবার বেলায় ধারাবর্ষণে যদি ক্লান্তি প্ৰকাশ করে তবে জনপদবধুরা তাই নিয়ে কি তাকে দুয়ো দেয় । আপনি নবশ্যামল ধানের খেতের মাঝখানে দাড়িয়ে মনে কি করে না আষাঢ়ে। এই মেঘেরই প্ৰথম সমাগমের দাক্ষিণ্যসমারোহের কথা । কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সাহিত্যের ক্ষেত্রেই এই সীেজন্যের দাবি প্ৰায় ব্যর্থ হয় । বৈষয়িক ক্ষেত্রেও পূর্বকৃত কর্মের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভদ্ররীতি আছে। পেনশনের প্রথা তার প্রমাণ। কিন্তু, সাহিত্যেই পূর্বের কথা স্মরণ করে শক্তির হ্রাস ঘটাকে অনেকেই ক্ষমা করতে চায় না । এই তীব্ৰ প্রতিযোগিতার দিনে অনেকেই এতে উল্লাস অনুভব করে । কষ্টকল্পনার জোরে হালের কাজের ত্রুটি প্রমাণ করে সাবেক কাজের মূল্যকে খর্ব করবার জন্যে তাদের উত্তপ্ত আগ্ৰহ । শোনা যায়, কোনো কোনো দেশে এমন মানুষ আছে যারা তাদের সমাজের প্রবীণ লোকের শক্তির কৃশতা অনুমান করলে