পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে @や)> রস পেয়েছেন তারা তখনকার কালের নবীনা হলেও প্রাচীনকালীন সংস্কারের বাহিরে তাদের গতি ছিল অনভ্যস্ত । আর কিছু না হােক, ইংরেজি তারা পড়েন নি । এ কথা মানতেই হবে, বঙ্কিম তীর নভেলে আধুনিক রীতিরই রূপ ও রস এনেছিলেন । তার ভাষা পূৰ্ববতী প্রাকৃত বাংলা ও সংস্কৃত বাংলা থেকে অনেক ভিন্ন । তার রচনার আদর্শ কি বিষয়ে কি ভাবে কি ভঙ্গিতে পাশ্চাত্যের আদর্শের অনুগত তাতে কোনো সন্দেহ নেই । সেকালে ইংরেজিভাষায় বিদ্বান বলে র্যাদের অভিমান তারা তখনো তার লেখার যথেষ্ট সমাদর করেন নি ; অথচ সে-লেখা ইংরেজি শিক্ষাহীন তরুণীদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে বাধা পায় নি, এ আমরা দেখেছি। তাই সাহিত্যে আধুনিকতার আবির্ভাবকে আর তো ঠেকানো গেল না । এই নব্য রচনানীতির ভিতর দিয়ে সেদিনকার বাঙালি-মন মানসিক চিরাভাস্যের অপ্রশস্ত বেষ্টনকে অতিক্রম করতে পারলে— যেন অসূর্যাম্পশ্যরূপ অন্তঃপুরচারিণী আপন প্রাচীর-ঘেরা প্রাঙ্গণের বাইরে এসে দাড়াতে পেরেছিল । এই মুক্তি সনাতন রীতির অনুকুল না হতে পারে। কিন্তু সে যে চিরন্তন মানবপ্রকৃতির অনুকুল, দেখতে দেখতে তার প্রমাণ পড়ল ছড়িয়ে । এমন সময়ে বঙ্গদর্শন মাসিক পত্র দেখা দিল । তখন থেকে বাঙালির চিত্তে নব্য বাংলাসাহিত্যের অধিকার দেখতে দেখতে অবারিত হল সর্বত্র । ইংরেজি-ভাষায় র্যারা প্ৰবীণ র্তারাও একে সবিস্ময়ে স্বীকার করে নিলেন । নব্যসাহিত্যের হাওয়ায় তখনকার তরুণী পাঠিকাদের মনঃপ্রকৃতির যে পরিবর্তন হতে আরম্ভ হয়েছিল, সে কথা নিঃসন্দেহ । তরুণীরা সবাই রোমাণ্টিক হয়ে উঠছে, এইটেই তখনকার দিনের ব্যঙ্গরসিকদের প্রহসনের বিষয় হয়ে উঠল । কথাটা সত্য । ক্লাসিকের অর্থাৎ চিরাগত রীতির বাইরেই রোমাণ্টিকের লীলা । রোমাণ্টিকে মুক্ত ক্ষেত্রে হৃদয়ের বিহার। সেখানে অনভ্যস্ত পথে ভাবাবেগের আতিশয্য ঘটতে পারে। তাতে করে পূর্ববতী বাধা নিয়মানুবর্তনের তুলনায় বিপজ্জনক, এমন-কি, হাস্যজনক হয়ে উঠবার আশঙ্কা থাকে । দাড থেকে ছাড়া পাওয়া কল্পনার পায়ে শিকল বাধা না থাকাতে ক্ষণে ক্ষণে হয়তো সে বঁাপিয়ে পড়ে অশোভনতায় । কিন্তু, বড়ো পরিপ্রেক্ষণিকায় ছডিয়ে দেখলে দেখা যায়, অভিজ্ঞতার বিচিত্র শিক্ষার মুক্তি মোটের উপরে সকলপ্রকার স্বলনকে অতিকৃতিকে সংশোধন করে চলে । যাই হােক, আধুনিক বাংলাসাহিত্যের গতিবেগ বাংলার ছেলেমেয়েকে কোন পথে নিয়ে চলেছে, এ সভায় তার আলোচনার উপলক্ষ নেই। এই সভাতেই বাংলাসাহিত্যের বিশেষ সফলতার যে প্ৰমাণ স্পষ্ট হয়েছে, সভার কার্যারম্ভের পূর্বে সূত্ৰধাররূপে আর তারই কথা জানিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য বলে মনে করি । এমন একদিন ছিল যখন বাংলা প্রদেশের বাইরে বাঙালি-পরিবার দুই-এক পুরুষ যাপন করতে করতেই বাংলাভাষা ভুলে যেত । ভাষার যোগই অন্তরের নাড়ীর যোগ- সেই যোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হলেই মানুষের পরম্পরাগত বুদ্ধিশক্তি ও হৃদয়বৃত্তির সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। বাঙালিচিত্তের যে-বিশেষত্ব মানবসংসারে নিঃসন্দেহ তার একটা বিশেষ মূল্য আছে। যেখানেই তাকে হারাই সেখানেই সমস্ত বাঙালিজাতির পক্ষে বড়ো ক্ষতির কারণ ঘটা সম্ভব । নদীর ধারে যে-জমি আছে তার মাটিতে যদি বাধন না থাকে। তবে তাঁট কিছু কিছু করে ধ্বসে পড়ে। ফসলের আশা হারাতে থাকে । যদি কোনো মহাবৃক্ষ সেই মাটির গভীর অন্তরে দূরব্যাপী শিকড় ছড়িয়ে দিয়ে তাকে এঁটে ধরে তা হলে স্রোতের আঘাত থেকে সে ক্ষেত্র রক্ষা পায় । বাংলাদেশের চিত্তক্ষেত্ৰকে তেমনি করেই ছায়া দিয়েছে, ফল দিয়েছে, নিবিড় ঐক্য ও স্থায়িত্ব দিয়েছে বাংলাসাহিত্য । অল্প আঘাতেই সে খণ্ডিত হয় না । একদা আমাদের রাষ্ট্রপতিরা বাংলাদেশের মাঝখানে বেড়া তুলে দেবার যে-প্ৰস্তাব করেছিলেন সেটা যদি আরো পঞ্চাশ বছর পূর্বে ঘটত, তবে তার আশঙ্কা আমাদের এক তীব্র আঘাতে বিচলিত করতে পারত না । ইতিমধ্যে বাংলার মর্মস্থলে যে অখণ্ড আত্মবোধ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তার প্রধানতম কারণ বাংলাসাহিত্যে । বাংলাদেশকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় খণ্ডিত করার ফলে তার ভাষা তার সংস্কৃতি খণ্ডিত হবে, এই বিপদের সম্ভাবনায় বাঙালি উদাসীন থাকতে পারে নি। বাঙালিচিত্তের এই ঐক্যবোধ সাহিত্যের যোগে বাঙালির চৈতন্যকে ব্যাপকভাবে গভীরভাবে অধিকার করেছে। সেই কারণেই আজ বাঙালি