পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G2W0 S রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী যত দূরে যেখানেই যাক বাংলা-ভাষা ও সাহিত্যের বন্ধনে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত থাকে । কিছুকাল পূর্বে বাঙালির ছেলে বিলাতে গেলে ভাষায় ভাবে ও ব্যবহারে যেমন স্পর্ধপূর্বক অবাঙালিত্বের আড়ম্বর করত, এখন তা নেই বললেই চলে- কেননা বাংলাভাষার যে-সংস্কৃতি আজ উজ্জ্বল তার প্রতি শ্রদ্ধা না প্ৰকাশ করা এবং তার সম্বন্ধে অনভিজ্ঞতাই আজ লজার বিষয় হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্ৰীয় ঐক্যসাধনার তরফ থেকে ভারতবর্ষে বঙ্গেতর প্রদেশের প্রতি প্ৰবাস শব্দ প্রয়োগ করায় আপত্তি থাকতে পারে । কিন্তু, মুখের কথা বাদ দিয়ে বাস্তবিকতার যুক্তিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে অকৃত্ৰিম আত্মীয়তার সাধারণ ভূমিকা পাওয়া যায় কি না, সে তর্ক ছেড়ে দিয়েও সাহিত্যের দিক থেকে ভারতের অন্য প্রদেশ বাঙালির পক্ষে প্রবাস সে কথা মানতে হবে । এ সম্বন্ধে আমাদের পার্থক্য এত বেশি যে, অন্য প্রদেশের বর্তমান সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির সামঞ্জস্যসাধন অসম্ভব। এ ছাড়া সংস্কৃতির প্রধান যে বাহন ভাষা সে সম্বন্ধে বাংলার সঙ্গে অন্যপ্রদেশীয় ভাষার কেবল ব্যাকরণের প্রভেদ নয় অভিব্যক্তির প্রভেদ । অর্থাৎ, ভাবের ও সত্যের প্রকাশকল্পে বাংলাভাষা নানা প্ৰতিভাশালীর সাহায্যে যে রূপ এবং শক্তি উদ্ভাবন করেছে, অন্য প্রদেশের ভাষায় তা পাওয়া যায় না, অথবা তার অভিমুখিতা অন্য দিকে । অথচ সে-সকল ভাষার মধ্যে হয়তো নানা বিষয়ে বাংলার চেয়ে শ্রেষ্ঠতা আছে । অন্য প্ৰদেশবাসীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বাঙালি-হৃদয়ের মিলন অসম্ভব নয় আমরা তার অতি সুন্দর দৃষ্টান্ত দেখেছি, যেমন পরলোকগত অতুলপ্ৰসাদ সেন । উত্তরপশ্চিমে যেখানে তিনি ছিলেন, মানুষ হিসাবে সেখানকার লোকের সঙ্গে তার হৃদয়ে হৃদয়ে মিল ছিল, কিন্তু সাহিত্যরচয়িতা বা সাহিত্যরসিক হিসাবে সেখানে তিনি প্ৰবাসীই ছিলেন এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই । তাই বলছি, আজ প্রবাসী-বঙ্গসাহিত্য-সন্মিলন বাঙালির অন্তরতম ঐক্যচেতনাকে সপ্ৰমাণ করছে। নদী যেমন স্রোতের পথে নানা বঁাকে বাকে আপন নানাদিকগামী তটকে এক করে নেয়, আধুনিক বাংলা-ভাষা ও সাহিত্য তেমনি করেই নানা দেশ-প্রদেশের বাঙালির হৃদয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাকে এক প্ৰাণধারায় মিলিয়েছে। সাহিত্যে বাঙালি আপনাকে প্রকাশ করেছে বলেই, আপনার কাছে আপনি সে আর অগোচর নেই বলেই, যেখানে যাক আপনাকে আর সে ভুলতে পারে না। এই আত্মানুভূতিতে তার গভীর আনন্দ বৎসরে বৎসরে নানা স্থানে নানা সম্মিলনীতে বারংবার উচ্ছসিত 20छ । অথচ সাহিত্য ব্যাপারে সম্মিলনীর কোনো প্রকৃত অর্থ নেই। পৃথিবীতে দশে মিলে অনেক কাজ হয়ে থাকে, কিন্তু সাহিত্য তার অন্তর্গত নয়। সাহিত্য একান্তই একলা মানুষের সৃষ্টি । রাষ্ট্রিক বাণিজ্যিক সামাজিক বা ধর্ম সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানে দল বাধা আবশ্যক হয় । কিন্তু, সাহিত্যসাধনা যার, যোগীর মতো তপস্বীর মতো সে একা। অনেক সময়ে তার কাজ দশের মতের বিরুদ্ধে। মধুসূদন বলেছিলেন “বিরচিব মধুচক্র” । সেই কবির মধুচক্ৰ একলা মধুকরের । মধুসূদন যেদিন মৌচাক মধুতে ভরছিলেন, সেদিন বাংলায় সাহিত্যের কুঞ্জবনে মৌমাছি ছিলই বা কয়টি । তখন থেকে নানা খেয়ালের বশবতী একলা মানুষে মিলে বাংলাসাহিত্যকে বিচিত্র করে গড়ে তুলল। এই বহু স্ৰষ্টার নিভৃত-তপো-জাত সাহিত্যলোকে বাংলার চিত্ত আপন অন্তরতম আনন্দভবন পেয়েছে, সম্মিলনীগুলি তারই উৎসব । বাংলা-সাহিত্য যদি দল-বাধা মানুষের সৃষ্টি হত তা হলে আজ তার কী দুৰ্গতিই ঘটত তা মনে করলেও বুক কেঁপে ওঠে । বাঙালি চিরদিন দলাদলি করতেই পারে, কিন্তু দল গড়ে তুলতে পারে না। পরম্পরের বিরুদ্ধে ঘোট করতে, চক্রান্ত করতে, জাত মারতে তার স্বাভাবিক আনন্দ- আমাদের সনাতন চণ্ডীমণ্ডপের উৎপত্তি সেই “আনন্দাদ্ধ্যোব । মানুষের সব চেয়ে নিকটতম যে-সম্বন্ধবন্ধন বিবাহব্যাপারে, গোড়াতেই সেই বন্ধনকে অহৈতুক অপমানে জর্জরিত করবার বরযাত্রিক মনোবৃত্তিই তো বাংলাদেশের সনাতন বিশেষত্ব । তার পরে কবির লড়াইয়ের প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি ব্যক্তিগত অশ্রাব্য গালিবর্ষণকে যারা উপভোগ করবার জন্যে একদা ভিড় করে সমবেত হত, কোনো পক্ষের প্রতি বিশেষ শক্রিতাবশতই যে তাদের সেই দুয়ো দেবার উচ্ছসিত উল্লাস তা তো নয়, নিন্দার