পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর Gł Ved ইহাও নিশ্চিত যে, জগতের সকল বড়ো জাতিই যে-ধর্মের বলে বড়ো হইয়াছে ইংরেজও সেই বলেই বড়ো ; অত্যন্ত রাগ করিয়াও এ কথা বলা চলিবে না যে, সে কেবল তলোয়ারের ডগায় ভর করিয়া উচু হইয়াছে কিংবা টাকার থলির উপরে চড়িয়া। কোনাে জাতিই টাকা করিতে কিংবা লড়াই করিতে পারে বলিয়াই ইতিহাসে গৌরব লাভ করিয়াছে। এ কথা অশ্রদ্ধেয় । মনুষ্যত্বে বড়ো না হইয়াও কোনো জাতি বড়ো হইয়াছে। এ কথাটাকে বিনা সাক্ষ্যপ্রমাণে গোড়াতেই ডিসমিস করা যাইতে পারে। ন্যায়, সত্য এবং স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা এই ইংরেজজাতির অন্তরের আদর্শ । সেই আদর্শ ইহাদের সাহিত্যে ও ইতিহাসে নানা আকারে ও অধ্যবসায়ে প্রকাশ পাইয়াছে এবং আজিকার মহাযুদ্ধেও সেই আদর্শ নানা ছলনা ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাহাদিগকে শক্তিদান করিতেছে । এই বড়ো-ইংরেজ স্থির নাই, সে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। ইতিহাসের মধ্য দিয়া তার জীবনের পরিবর্তন ও প্রসার ঘটিতেছে । সে কেবল তার রাষ্ট্র ও বাণিজ্য লইয়া নয়, তার শিল্প সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান ধর্ম ও সমাজ লইয়া পূৰ্ণপ্রবাহে চলিয়াছে। সে সৃজনধর্মী ; যুরোপীয় সভ্যতার বিরাট যজ্ঞে সে একজন প্রধান হােতা। বর্তমান যুদ্ধের মহৎ শিক্ষা তার চিত্তকে প্রতি মুহুর্তে আন্দোলিত করিতেছে। মৃত্যুর উদার বৈরাগ্য-আলোকে সে মানুষের ইতিহাসকে নূতন করিয়া পড়িবার সুযোগ পাইল । সে দুৰ্যোগটা কী । সে আজ নিজের গোচরে বা অগোচরে প্রত্যহ বুঝিতেছে যে, স্বজাতির যিনি দেবতা সর্বজাতির দেবতাই তিনি, এইজন্য র্তাহার পূজায় নরবলি আনিলে একদিন রুদ্র তার প্রলয়রূপ ধারণ করেন । আজ যদি সে না-ও বুঝিয়া থাকে, একদিন সে বুঝিবেই যে, হাওয়া যেখানেই পাতলা, ঝড়ের কেন্দ্ৰই সে জায়গাটায়- কেননা চারিদিকের মোটা হাওয়া সেই ফাক দখল করিতেই কুঁকিয়া পড়ে । তেমনি পৃথিবীর যে-সব দেশ দুর্বল, সবলের দ্বন্দ্বের কারণ সেখানেই ; লোভের ক্ষেত্র সেখানেই ; মানুষ সেখানে আপন মহৎ স্বরূপে বিরাজ করে না ; মানুষ প্রত্যহই সেখানে অসতর্ক হইয়া আপন মনুষ্যত্বকে শিথিল করিয়া বর্জন করিতে থাকে। শয়তান সেখানে আসন জুড়িয়া ভগবানকে দুর্বল বলিয়া বিদ্রুপ করে । বড়ো-ইংরেজ এ কথা বুঝিবেই যে, বালির উপর বাড়ি করা চলে না, একের শক্তিহীনতার উপরে অপরের শক্তির ভিত্তি কখনোই পাকা হইতে পারে না । কিন্তু ছোটো-ইংরেজ অগ্রসর হইয়া চলে না । যে-দেশকে সে নিশ্চল করিয়া বাধিয়াছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী সেই দেশের সঙ্গে সে আপনি-বাধা । তার জীবনের এক পিঠে আপিস, আর-এক পিঠে আমোদ । যে-পিঠে আপিস সে-পিঠে সে ভারতের বহুকোটি মানুষকে রাষ্টিকের রাজদণ্ডের বা বণিকের মানদণ্ডের ডগাটা দিয়া স্পর্শ করে, আর যে-পিঠে আমোদ সে-পিঠটা চাদের পশ্চাদিকের মত্নো, বৎসরের পর বৎসর সম্পূর্ণ অদৃশ্য। তবু কেবলমাত্র কালের অঙ্কপাত হিসাব করিয়া ইহারা অভিজ্ঞতার দাবি করে । ভারত-অধিকারের গোড়ায় ইহারা সৃজনের কাজে রত ছিল, কিন্তু তাহার পর বহুদীর্ঘকাল ইহারা পাকা সাম্রাজ্য ও পাকা বাণিজ্যকে প্রধানত পাহারা দিতেছে ও ভোগ করিতেছে । অসাড়তাকেই বল বলিয়া থাকে । তারা মনে করে তাদের আপিসটা সুনিয়মে চলিতেছে এইটেই বিশ্বের সব চেয়ে বড়ো ঘটনা । কিন্তু আপিসের জালনার বাহিরে রাস্তার ধুলার উপর দিয়া বিশ্বদেবতা তার রথযাত্রায় অতিদীনকেও যে নিজের সারথ্যেই চালাইতেছেন এই চালনাকে তারা অশ্রদ্ধা করে । অক্ষমের সঙ্গে নিয়ত কারবার করিয়া এ কথা তারা ধ্রুব বলিয়া ধরিয়া লইয়াছে, যেমন তারা বর্তমানের মালিক তেমনি তারা ভবিষ্যতের নিয়ন্তা । আমরা এখানে আসিয়াছি। এই কথা বলিয়াই তারা চুপ করে না, আমরা এখানে থাকিবই এই কথা বলিয়া তারা স্পর্ধা করে । অতএব, ওরে মরীচিকালুব্ধ দুৰ্ভাগা, বড়ো-ইংরেজের কাছ হইতে জাহাজ বোঝাই করিয়া ব্যর আসিতেছে কেবল এই আশাটাকে বুকে করিয়াই পশ্চিমের ঘাটের দিকে অত বেশি কলরব করিতে করিতে ছুটিয়ে না। এই আশঙ্কটাকেও মনে রাখিয়ে যে, ভারতসাগরের তলায় তলায় ছোটো-ইংরেজের ‘মাইন’ স্যার বাধিয়া আছে । এটা অসম্ভব নয় যে তোমার ভাগ্যে জাহাজের যে ভাঙা