পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর (? り○ অতিশয়-পন্থা বলিতে আমরা এই বুঝি, যে-পন্থা না ভদ্র, না বৈধ, না প্ৰকাশ্য ; অর্থাৎ সহজ পথে ফলের আশা ত্যাগ করিয়া অপথে বিপথে চলাকেই ‘একট্ৰিমিজম বলে। এই পথটা যে নিরতিশয় গৰ্হিত সে কথা আমি জোরের সঙ্গেই নিজের লোককে বলিয়াছি, সেইজন্যই আমি জোরের সঙ্গেই বলিবার অধিকার রাখি যে, “একট্ৰিমিজম গবর্মেন্টের নীতিতেও অপরাধ। আইনের রাস্তা বাধা রাস্তা বলিয়া মাঝে মাঝে তাহাতে গম্যস্থানে পৌঁছিতে ঘুর পড়ে বটে, কিন্তু তাই বলিয়া বেলজিয়ামের বুকের উপর দিয়া সোজা হাটিয়া রাস্তা সংক্ষেপ করার মতো "একস্ট্রিমিজম কাহাকেও শোভা পায় না । ইংরেজিতে যাকে ‘শর্টকাটু বলে আদিমকালের ইতিহাসে তাহা চলিত ছিল। “লে আও, উসকো শির লে আও” এই প্ৰণালীতে গ্ৰন্থি খুলিবার বিরক্তি বঁচিয়া যাইত, এক কোপে গ্ৰন্থি কাটা পড়িত । য়ুরোপের অহংকার এই যে, সে আবিষ্কার করিয়াছে এই সহজ প্রণালীতে গ্ৰন্থি কাটা পড়ে বটে কিন্তু মালের গুরুতর লোকসান ঘটে । সভ্যতার একটা দায়িত্ব আছে, সকল সংকটেই সে দায়িত্ব তাহাকে রক্ষা করিতে হইবে । শান্তি দেওয়ার মধ্যে একটা দারুণ্যতা অনিবাৰ্য বলিয়াই শান্তিটাকে ন্যায়বিচার-প্ৰণালীর ফিলটারের মধ্য দিয়া ব্যক্তিগত রাগদ্বেষ- ও পক্ষপাত- পরিশূন্য করিয়া সভ্যসমাজ তবে তাহাকে গ্ৰহণ করিতে পারে । তাহা না হইলেই লাঠিয়ালের লাঠি এবং শাসনকর্তার ন্যায়দণ্ডের মধ্যে প্ৰভেদ বিলুপ্ত হইতে থাকে। স্বীকার করি, কাজ কঠিন হইয়াছে। বাংলাদেশের একদল বালক ও যুবক স্বদেশের সঙ্গে স্বদেশীর সত্য যোগসাধনের বাধা-অতিক্রমের যে পথ অবলম্বন করিয়াছে তাহার জন্য আমরা লজিত আছি । আরো লজ্জিত এইজন্য যে, দেশের প্রতি কর্তব্যনীতির সঙ্গে ধর্মনীতির বিচ্ছেদসাধন করায় অকর্তব্য নাই। এ কথা আমরা পশ্চিমের কাছ হইতেই শিখিয়াছি । পলিটিক্সের গুপ্ত ও প্রকাশ্য মিথ্যা এবং পলিটিক্সের গুপ্ত ও প্রকাশ দসু্যবৃত্তি পশ্চিম সোনার সহিত খাদ মিশানোর মতো মনে করেন, মনে করেন ওটুকু না থাকিলে সোনা শক্ত হয় না। আমরাও শিখিয়াছি যে, মানুষের পরমার্থকে দেশের স্বার্থের উপরে বসাইয়া ধৰ্ম লইয়া টিকটিক করিতে থাকা মূঢ়তা, দুর্বলতা, ইহা সেন্টিমেন্টালিজমবর্বরতাকে দিয়াই সভ্যতাকে এবং অধৰ্মকে দিয়াই ধর্মকে মজবুত করা চাই। এমনি করিয়া আমরা যে কেবল অধৰ্মকে বরণ করিয়া লইয়াছি তাহা নহে, আমাদের গুরুমশায়দের যেখানে বীভৎসতা, সেই বীভৎসতার কাছে মাথা হেঁট করিয়াছি । নিজের মনের জোরে ধর্মের জোরে গুরুমশায়ের উপরে দাড়াইয়াও এ কথা বলিবার তেজ ও প্ৰতিভা আমাদের আজ নাই যে, অধমোনৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি, ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলন্ত বিনশ্যতি । অর্থাৎ অধর্মের দ্বারা মানুষ বাড়িয়া উঠে, অধর্ম হইতে সে আপনি কল্যাণ দেখে, অধর্মের দ্বারা সে শত্রুদিগকেও জয় করে, কিন্তু একেবারে মূল হইতে বিনাশ পায়। তাই বলিতেছি, গুরুমশায়দের কাছে আমাদের ধর্মবুদ্ধিরও যে এত বড়ো পরাভব হইয়াছে ইহাতেই আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো লজা । বড়ো আশা করিয়াছিলাম, দেশে যখন দেশভক্তির আলোক জ্বলিয়া উঠিল তখন আমাদের প্রকৃতির মধ্যে যাহা সকলের চেয়ে মহৎ তাহাই উজ্জ্বল হইয়া প্ৰকাশ পাইবে ; আমাদের যাহা যুগসঞ্চিত অপরাধ তাহা আপন অন্ধকার কোণ ছাড়িয়া পালাইয়া যাইবে ; দুঃসহ নৈরাশ্যের পাষাণপ্তর বিদীর্ণ করিয়া অক্ষয় আশার উৎস উৎসারিত হইয়া উঠিবে এবং দুরূহ নিরুপায়তাকেও উপেক্ষা করিয়া অপরাহত ধৈৰ্য এক-এক পা করিয়া আপনার রাজপথ নির্মাণ করিবে ; নিষ্ঠুর আচারের ভারে এ দেশে মানুষকে মানুষ যে অবনত অপমানিত করিয়া রাখিয়াছে অকৃত্রিম শ্ৰীতির আনন্দময় শক্তির দ্বারা সেই ভারকে দূর করিয়া সমস্ত দেশের লোক একসঙ্গে মাথা তুলিয়া দাড়াইব । কিন্তু আমাদের ভাগ্যে এ কী হইল। দেশভক্তির আলোক জ্বলিল, কিন্তু সেই আলোতে এ কোন দৃশ্য দেখা যায়- এই চুরি ডাকাতি গুপ্তহত্যা ? দেবতা যখন প্রকাশিত হইয়াছেন তখন পাপের অর্ঘ্য লইয়া তাহার পূজা ? যে-দৈন্য যে-জড়তায় এতকাল আমরা পোলিটিকাল ভিক্ষাবৃত্তিকেই সম্পদলাভের সদুপায় বলিয়া কেবল রাজদরবারে দরখাস্ত লিখিয়া হাত পাকাইয়া আসিয়াছি, দেশগ্ৰীতির নববসন্তেও সেইদৈন্য সেই জড়তা