পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(¢ዒ O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী গরজ কোনো-এক জায়গায় আছে ; সেই গরজ অনুসারেই আমাকে মূল্য দেওয়া হয়েছে। আমি থাকি এই ইচ্ছার আনুচর্য সমস্ত বিশ্ব করছে, বিশ্বের সমস্ত অণুপরমাণু। সেই পরম-ইচ্ছার গীের বই আমার অহংকারে বিকশিত । সেই ইচ্ছার গৌরবেই এই অতিক্ষুদ্র আমি বিশ্বের কিছুর চেয়েই পরিমাণ ও মূল্যে का न्छ । এই ইচ্ছাকে মানুষ দুই রকম ভাবে দেখেছে। কেউ বলেছে। এ হচ্ছে শক্তিময়ের খেয়াল, কেউ বলেছে। এ হচ্ছে আনন্দময়ের আনন্দ । আর যারা বলেছে, এ হচ্ছে মায়া, অর্থাৎ যা নেই তারই থাকা, তাদের কথা ছেড়ে দিলুম। আমার থাকাটা শক্তির প্রকাশ, না, প্রীতির প্রকাশ, এইটে যে-যেমন মনে করে সে সেইভাবে জীবনে লক্ষ্যকে স্থির করে । শক্তিতে আমাদের যে-মূল্য দেয় তার এক চেহারা, আর গ্ৰীতিতে আমাদের যে-মূল্য দেয় তার চেহারা সম্পূর্ণ আলাদা। শক্তির জগতে আমার অহংকারের যে দিকে গতি, শ্ৰীতির জগতে আমার অহংকারের গতি ঠিক তার উলটো দিকে । শক্তিকে মাপা যায় ; তার সংখ্যা, তার ওজন, তার বেগ সমস্তেরই আয়তন গণিতের অঙ্কের মধ্যে ধরা পড়ে । তাই যারা শক্তিকেই চরম বলে জানে তারা আয়তনে বড়ো হতে চায় । টাকার সংখ্যা, লোকের সংখ্যা, উপকরণের সংখ্যা, সমস্তকেই তারা কেবল বহুগুণিত করতে থাকে । এইজনেই সিদ্ধিলাভের কামনায় এরা অন্যের অর্থ, অন্যের প্রাণ, অন্যের অধিকারকে বলি দেয় । শক্তিপূজার প্রধান অঙ্গ বলিদান । সেই বলির রক্তে পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে। বস্তুতন্ত্রের প্রধান লক্ষণই হচ্ছে তার বাহ্যপ্রকাশের পরিমাপ্যতা- অর্থাৎ তার সসীমতা । মানুষের ইতিহাসে যতী-কিছু দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলা তার অধিকাংশই এই সীমানার চৌহদি নিয়ে । পরিমাণের দিকে নিজের সীমানা অত্যন্ত বাড়াতে গেলেই পরিমাণের দিকে অন্যের সীমানা কাড়তে হয়। অতএব শক্তির অহংকার যেহেতু আয়তন বিস্তারেরই অহংকার, সেইজন্যে এই দিকে দাড়িয়ে খুব লম্বা দূরবীন কষলেও লড়াইয়ের রক্তসমুদ্র পেরিয়ে শান্তির কুল কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই যে বস্তুতান্ত্রিক বিশ্ব, এই যে শক্তির ক্ষেত্র, এর আয়তনের অঙ্কগুলো যোগ দিতে দিতে হঠাৎ এক জায়গায় দেখি তেরিজটা একটানা বেড়ে চলবার দিকেই ছুটছে না । বেড়ে চলবার তত্ত্বের মধ্যে হঠাৎ উচোট খেয়ে দেখা যায় সুষমার তত্ত্ব পথ আগলে । দেখি কেবলই গতি নয়, যতিও আছে। ছন্দের এই অমোঘ নিয়মকে শক্তি যখন অন্ধ অহংকারে অতিক্রম করতে যায়। তখনই তার আত্মঘাত ঘটে । মানুষের ইতিহাসে এইরকম বার বার দেখা যাচ্ছে । সেইজন্যে মানুষ বলেছে, অতি দৰ্পে হতা লঙ্কা । সেইজন্যে ব্যাবিলনের অত্যুদ্ধত সীেধচুড়ার পতনবার্তা এখনো মানুষ স্মরণ করে । তবেই দেখছি, শক্তিতত্ত্ব, যার বাহ্যপ্রকাশ আয়তনে, সেটাই চরমতত্ত্ব এবং পরমতত্ত্ব নয় । বিশ্বের তাল মেলাবার বেলায় আপনাকে তার থামিয়ে দিতে হয় । সেই সংযমের সিংহদ্বারই হচ্ছে কল্যাণের সিংহদ্বার । এই কল্যাণের মূল্য আয়তন নিয়ে নয়, বহুলতা নিয়ে নয় । যে একে অন্তরে জেনেছে, সে ছিন্ন কস্থায় লজ্জা পায় না, সে রাজমুকুট ধূলোয় লুটিয়ে দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়তে পারে। শক্তিতত্ত্ব থেকে সুষমাতত্ত্বে এসে পৌঁছিয়েই বুঝতে পারি, ভুল জায়গায় এতদিন এত নৈবেদ্য জুগিয়েছি। বলির পশুর রক্তে যে-শক্তি ফুলে উঠল। সে কেবল ফেটে মরবার জন্যেই। তার পিছনে যতই সৈন্য যতই কামান লাগাই-না কেন, রণতরীর পরিধি যতই বৃদ্ধির দিকে নিয়ে চলি, লুঠের ভাগকে যতই বিপুল করে তুলতে থাকি, অঙ্কের জোরে মিথ্যাকে সত্য করা যাবে না, শেষকালে ঐ অতিবড়ো অঙ্কেরই চাপে নিজের বস্তার নীচে নিজে গুড়িয়ে মরতে হবে । যাজ্ঞবল্ক্য যখন জিনিসপত্র বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিয়ে এই অঙ্ক-কষার রাজ্যে মৈত্ৰেয়ীকে প্রতিষ্ঠিত করে বিদায় নিচ্ছিলেন, তখনই মৈত্ৰেয়ী বলেছিলেন, যেনাহং নামৃতা স্যাম কিমহং তেন। কুৰ্যাম! বহু, বহু, বহু সব বহুকে জুড়ে জুড়েও অঙ্কের পর অঙ্ক যোগ করে করেও তবু তো অমৃতে গিয়ে পৌঁছনো যায় না । শব্দকে কেবলই অত্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে এবং চড়িয়ে দিয়ে যে-জিনিসটা পাওয়া যায় সেটা হল হুংকার আর শব্দকে সুর দিয়ে লয় দিয়ে সংযত সম্পূর্ণতা দান করলে যে-জিনিসটা পাওয়া যায়