পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ ዓ S রবীন্দ্র-রচনাবলী তাদের উপদেশকে আমরা মাথায় লই, এবং মৃত্যু ও সকল ভয়ের অতীত যে-শান্তি সেই শান্তিতে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করি । R কারও উঠোন চষে দেওয়া আমাদের ভাষায় চূড়ান্ত শান্তি বলে গণ্য । কেননা উঠোনে মানুষ সেই বৃহৎ সম্পদকে আপন করেছে, যেটাকে বলে ফাঁক । বাহিরে এই ফাক দুর্লভ নয়, কিন্তু সেই বাহিরের জিনিসকে ভিতরের করে আপনার করে না তুললে তাকে পেয়েও না পাওয়া হয় । উঠোনে ফাকটাকে মানুষ নিজের ঘরের জিনিস করে তোলে ; ঐখানে সূর্যের আলো তার ঘরের আপনার আলো হয়ে দেখা দেয়, ঐখানে তার ঘরের ছেলে আকাশের চাদকে হাততালি দিয়ে ডাকে । কাজেই উঠোনকেও যদি বেকার না রেখে তাকে ফসলের খেত বানিয়ে তোলা যায়, তা হলে যে-বিশ্ব মানুষের আপনি ঘরের বিশ্ব, তারই বাসা ভেঙে দেওয়া হয় । সীতাকার ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে প্ৰভেদ এই যে, ধনী এই ফাকটাকে বড়ো করে রাখতে পারে। যে-সমস্ত জিনিসপত্র দিয়ে ধনী আপনার ঘর বোঝাই করে তার দাম খুব বেশি, কিন্তু যে-ফ্যাকটা দিয়ে তার আঙিনা হয় প্রশস্ত, তার বাগান হয় বিস্তীৰ্ণ সেইটেই হচ্ছে সব চেয়ে দামি। সদাগরের দোকানঘর জিনিসপত্রে ঠাসা ; সেখানে ফাক রাখবার শক্তি তার নেই। দোকানো সদাগর কৃপণ, সেখানে লক্ষপতি হয়েও সে দরিদ্র । কিন্তু সেই সদাগরের বাসের বাড়িতে ঘরগুলো লম্বায় চওড়ায় উচুতে সকল দিকেই প্রয়োজনকে ধিক্কার করে ফাকটাকেই বেশি আদর দিয়েছে, আর বাগানের তো কথাই নেই । এইখানেই সদাগর ধনী । শুধু কেবল জায়গার ফাঁকা নয়, সময়ের ফাকাও বহুমূল্য। ধনী তার অনেক টাকা দিয়ে এই অবকাশ। কিনতে পায় । তার ঐশ্বর্যের প্রধান লক্ষণ এই যে, লম্বা লম্বা সময় সে ফেলে রাখতে পারে । হঠাৎ কেউ তার সময়ের উঠোন চাষতে পারে না । আর-একটা ফাকা, যেটা সব চেয়ে দামি, সে হচ্ছে মনের ফাকা । যা-কিছু নিয়ে মন চিন্তা করতে বাধ্য “হয়, কিছুতেই ছাড় পায় না, তাকেই বলে দুশ্চিন্তা । গরিবের চিন্তা, হতভাগার চিন্তা মনকে একেবারে আঁকড়ে থাকে, অশথগাছের শিকড়গুলো ভাঙা মন্দিরকে যে-রকম আঁকড়ে ধরে । দুঃখ জিনিসটা আমাদের চৈতন্যের ফাক বুজিয়ে দেয়। শরীরের সুস্থ অবস্থা তাকেই বলে যেটা হচ্ছে শারীর চৈতন্যের ফাকা ময়দান । কিন্তু হােক দেখি বা পায়ের কড়ে আঙুলের গাটের প্রান্তে বাতের বেদনা, অমনি শারীর চৈতন্যের ফাক বুজে যায়, সমস্ত চৈতন্য ব্যথায় ভরে ওঠে । মন যে ফাকা চায়, দুঃখে সেই ফাকা পায় না। স্থানের ফাকা না পেলে যেমন ভালো করে বাচা যায় না, তেমনি সময়ের ফাকা, চিন্তার ফাকা না পেলে মন বড়ো করে ভাবতে পারে না ; সত্য তার কাছে ছোটো হয়ে যায় । সেই ছোটো-সত্য মিটমিটে আলোর মত ভয়কে প্রশ্রয় দেয়, দৃষ্টিকে প্রতারণা করে এবং মানুষের ব্যবহারের ক্ষেত্ৰকে সংকীর্ণ করে রাখে । কাছটাতে এসে । আমাদের ভাগ্যে জানলার ফাক গেছে বুজে ; জীবনের এ-কোণে ও-কোণে একটু-আধটু যা ছুটির পোড়ো জায়গা ছিল তা কাটােগাছে ভরে গেল । প্রাচীন ভারতে একটা জিনিস প্রচুর ছিল, সেটাকে আমরা খুব মহামূল্য বলেই জানি, সে হচ্ছে সত্যকে খুব বড়ো করে ধ্যান করবার এবং উপলব্ধি করবার মতো মনের উদার অবকাশ । ভারতবর্ষ একদিন সুখ এবং দুঃখ, লাভ এবং অলাভের উপকার সব চেয়ে বড়ো ফাকায় দাড়িয়ে সেই সত্যকেই সুস্পষ্ট করে দেখছিল, যং লবধবা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ। কিন্তু আজকের দিনে ভারতবর্ষের সেই ধ্যানের বড়ো অবকাশটি নষ্ট হল । আজকের দিনের ভারতবাসীর আর ছুটি নেই ; তার মনের অন্তরতম ছুটির উৎসটি শুকিয়ে শুকিয়ে মরে গেল, বেদনায়