পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর @ ዒ 6: পারে। পাকার্বাধি বেঁধে এবং অন্যদের পারে পাকাখাদি কেটে লোভের স্রোতটাকে নিজেদের দিক থেকে অন্য দিকে সরিয়ে দেয় । বসুন্ধরাকে এমন জায়গায় পরস্পর বখরা করে নিতে চায় যো-জায়গাটা যথেষ্ট নরম, অনায়াসেই যেখানে দাত বসে, এবং ছিড়তে গিয়ে নখে যদি আঘাত লাগে, নখ তার শোধ তুলতে পারে । কিন্তু জোর করে বলা যায় এমন ভাবে চিরদিন চলবে না ; ভাগ সমান হবে না, লোভের ক্ষুধা সব জায়গায় সমান করে ভরবে না, পাপের ছিদ্র নানা জায়গায় থেকে যাবে ; হঠাৎ একদিন ভরাডুবি হবে । বিধাতা আমাদের একটা দিকে নিশ্চিন্ত করেছেন, ঐ বলের দিকটায় আমাদের রাস্তা একেবারে শেষ ফাকিটুকু পর্যন্ত বন্ধ, যে-আশা রাস্তা না পেলেও উড়ে চলে সেই আশারও ডানা কাটা পড়েছে। আমাদের জন্যে কেবল একটা বড়ো পথ আছে, সে হচ্ছে দুঃখের উপরে যাবার পথ | রিপু আমাদের বাইরে থেকে আঘাত দিচ্ছে দিক, তাকে আমরা অন্তরে আশ্রয় দেব না । যারা মারে তাদের চেয়ে আমরা যখন বড়ো হতে পারব তখন আমাদের মারা-খাওয়া ধন্য হবে । সেই বড়ো হবার পথ না লড়াই করা, না দরখাস্ত লেখা । অথ ধীরা অমৃতত্বং বিদিত্বা ধ্ৰুবম অধুবেষিহ ন প্ৰাৰ্থয়ন্তে । V) অন্যের সঙ্গে কথা কওয়া এবং অন্যের সঙ্গে চিঠি লেখার ব্যবস্থা আছে সংসার জুড়ে । আর নিজের সঙ্গে ? সেটা কেবল এই বাতায়নটুকুতে । কিন্তু নিজের মধ্যে কার সঙ্গে কে কথা কয় । একটা উপমা দেওয়া যাক । মাটির জলের খানিকটা সূক্ষ্ম হয়ে মেঘ হয়ে আকাশে উড়ে যায়। সেখান থেকে সেই নির্মল দূরত্বের সংগীত এবং উদার বেগ নিয়ে ধারায় ধারায় পুনর্বার সে মাটির জলে ফিরে আসতে থাকে । এই জলেরই মতো মানুষের মনের একটা ভাগ সংসারের উর্ধের্ব আকাশের দিকে উড়ে যায়, সেই আকাশচারী মনটা মাঝে মাঝে আবার যদি এই ভূচর মনের সঙ্গে মিলতে পারে তবে তাতেই পূর্ণতা घ6 । কিন্তু এমন-সকল মরুপ্রদেশ আছে যেখানে প্রায় সমস্ত বৎসর ধরেই অনাবৃষ্টি । বাষ্প হয়ে যা উপরে চলে গেল। বর্ষণ হয়ে তা আর ধরায় নেমে আসে না । নীচের মনের সঙ্গে উপরের মনের আর মিলন হয় না । সেখানে খাল-কটা জলে কাজ চলে যায়, কিন্তু সেখানে আকাশের সঙ্গে মাটির শুভসংগমের সংগীত এবং শঙ্খধ্বনি কোথায় । সেখানে বর্ষণমুখরিত রসের উৎসব হল না । সেখানে মনের মধ্যে চিরবিরহের একটা শুষ্কতা রয়ে গেল । এ তো গেল অনাবৃষ্টির কথা। এ ছাড়া মাঝে মাঝে কান্দাবৃষ্টি রক্তবৃষ্টি প্রভৃতি নানা উৎপাতের কথা শোনা যায়। আকাশের বিশুদ্ধতা যখন চলে যায়, বাতাস যখন পৃথিবীর নানা আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে থাকে, তখনই এই সব কাণ্ড ঘটে । তখন আকাশের বাণীও নির্মল হয়ে পৃথিবীকে পবিত্র করে না। পৃথিবীরই পাপ পৃথিবীতে ফিরে আসতে থাকে। আজকের দিনে সেই দুৰ্যোগ ঘটেছে। পৃথিবীর পাপের ধূলিতে আকাশের বর্ষণও আবিল হয়ে নামছে। নির্মল ধারায় পুণ্যমানের জন্যে অনেক দিনের যে-প্ৰতীক্ষা তাও আজ বারে বারে ব্যর্থ হল । মনের মধ্যে কাদা লাগছে এবং রক্তের চিহ্ন এসে পড়ছে ; বার বার কত আর মুছব।। রক্তকলঙ্কিত পৃথিবী থেকে ঐ যে আজ একটা শান্তির দরবার উঠেছে, উর্ধর্ব আকাশের নির্মল নিঃশব্দতা তার বেসুরকে ধুয়ে দিতে পারছে না। শান্তি ? শান্তির দরবার সত্য সত্যই কে-করতে পারে । ত্যাগের জন্যে যে প্ৰস্তুত । ভোগেরই জন্যে, লাভেরই জন্যে যাদের দশ আঙুল অজগর সাপের দশটা লেজের মতো কিলবিল করছে তারা শান্তি