পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর 2br○ সে-দেশে এই সকল অধিকারের জন্যে পরের বদান্যতার উপরে নির্ভর করতে হয় । কিন্তু আমি পূর্বেই বলেছি মানুষ যেখানে নিজেকে নিজে অত্যন্ত ছোটাে এবং অপমানিত করে রাখে সেখানে তার কোনো দাবি স্বভাবত কারও মনে গিয়ে পৌঁছয় না । সেইজন্যে তাদের সঙ্গে যে-সকল প্রবলের ব্যবহার চলে সেই প্ৰবলদের প্রতিদিন দুৰ্গতি ঘটতে থাকে । মানুষের সঙ্গে আচরণের আদর্শ তাদের না নেমে গিয়ে থাকতে পারে না । ক্রমশই তাদের পক্ষে অন্যায়, ঔদ্ধত্য এবং নিষ্ঠুরতা। স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে । নিজের ইচ্ছাকে অন্যের প্রতি প্রয়োগ করা তাদের পক্ষে একান্ত সহজ হওয়াতেই মানবস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা নিজের অগোচরেই তাদের মনে শিথিল হয়ে আসে । ক্ষমতা যতই অবাধ হয় ক্ষমতা ততই মানুষকে নীচের দিকে নিয়ে যায়। এইজন্যে ক্ষমতাকে যথোচিত পরিমাণে বাধা দেবার শক্তি যার মধ্যে নেই তার দুর্বলতা সমস্ত মানুষেরই শত্ৰু । আমাদের সমাজ মানুষের ভিতর থেকে সেই বাধা দূর করবার একটা অতি ভয়ংকর এবং অতি প্ৰকাণ্ড যন্ত্র । এই যন্ত্র এক দিকে বিধান-অক্ষৌহিণী দিয়ে আমাদের চার দিকে বেড়ে ধরেছে, আর-এক দিকে, যে-বুদ্ধি যে-যুক্তি দ্বারা আমরা এর সঙ্গে লড়াই করে মুক্তিলাভ করতে পারতুম, সেই বুদ্ধিকে সেই যুক্তিকে একেবারে নির্মূল করে কেটে দিয়েছে। তার পরে অন্য দিকে অতি লঘু ত্রুটির জন্যে অতি গুরুদণ্ড । খাওয়া শোওয়া ওঠা বসার তুচ্ছতম স্বলন সম্বন্ধে শান্তি অতি কঠোর । এক দিকে মুঢ়তার ভারে অন্য দিকে ভয়ের শাসনে মানুষকে অভিভূত করে জীবনযাত্রার অতি ক্ষুদ্র খুঁটিনাটি সম্বন্ধেও তার স্বাভিরুচি ও স্বাধীনতাকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। তার পরে ? তার পরে ভিক্ষা, ভিক্ষা না মিললে কান্না । এই ভিক্ষা যদি অতি সহজেই মেলে, আর এই কান্না যদি অতি সহজেই থামে, তা হলে সকল প্রকার মারের চেয়ে অপমানের চেয়ে সে আমাদের বড়ো দুৰ্গতির কারণ হবে । নিজেকে আমরা নিজে ছোটাে করে রাখব, আর অন্যে আমাদের বড়ো অধিকার দিয়ে প্রশ্ৰয় দেবে এই অভিশাপ বিধাতা আমাদের দেবেন না বলেই আমাদের এত দুঃখের পর দুঃখ । জাহাজের খোলের ভিতরটায় যখন জল বোঝাই হয়েছে তখনই জাহাজের বাইরেকার জলের মার সাংঘাতিক হয়ে ওঠে। ভিতরকার জলটা তেমন দৃশ্যমান নয়, তার চালচলন তেমন প্রচণ্ড নয়, সে মারে ভারের দ্বারা, আঘাতের দ্বারা নয়, এইজন্যে বাইরের ঢেউয়ের চড়-চাপড়ের উপরেই দোষারোপ করে তৃপ্তি লাভ করা যেতে পারে ; কিন্তু হয় মরতে হবে নয় একদিন এই সুবুদ্ধি মাথায় আসবে যে আসল মরণ ঐ ভিতরকার জলের মধ্যে, ওটাকে যত শীঘ্র পারা যায় সেঁচে ফেলতেই হবে । কাজটা যদি দুঃসাধ্যও হয় তবু এ কথা মনে রাখা চাই যে, সমুদ্র সেঁচে ফেলা সহজ নয়, তার চেয়ে সহজ, খোলের জল সেঁচে ফেলা । এ কথা মনে রাখতে হবে, বাইরে বাধাবিঘ্ন বিরুদ্ধতা চিরদিনই থাকবে, থাকলে ভালো বৈ মন্দ নয়- কিন্তু অন্তরে বাধা থাকলেই বাইরের বাধা ভয়ংকর হয়ে ওঠে । এইজন্যে ভিক্ষার দিকে না তাকিয়ে সাধনার দিকে তাকাতে হবে, তাতে অপমানও যাবে, ফলও পাব । ৫। জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ শক্তিপূজা ‘বাতায়নিকের পত্রে আমি শক্তিপূজার যে আলোচনা করেছি। সে সম্বন্ধে সাময়িকপত্রে একাধিক লোকে প্ৰতিবাদ লিখেছেন । আমাদের দেশে শিব এবং শক্তির স্বরূপ সম্বন্ধে দুটি ধারা দেখতে পাই। তার মধ্যে একটিকে শান্ত্রিক এবং আর-একটিকে লৌকিক বলা যেতে পারে । শান্ত্রিক শিব যতী, বৈরাগী । লৌকিক শিব উন্মত্ত, উচ্চক্ষুঙ্খল। বাংলা মঙ্গলকাব্যে এই লৌকিক শিবেরই বর্ণনা দেখতে পাই। এমন-কি, রাজসভার কবি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে শিবের যে চরিত্র বর্ণিত সে আর্যসমাজসম্মত নয় ।