পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর ○ ケ(? আছে, তার চেয়ে বড়ো শক্তিপূজার কথা কোনো বিশেষ শাস্ত্ৰে নিগুঢ় আছে কি না সেটা আমার আলোচ্য ছিল না । শক্তিপূজার যে-অর্থ লৌকিক বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত, সে-অর্থকে অসংগত বলা যায় না ; কারণ লোকপ্রচলিত কাহিনী এবং রূপকাঁচিহ্নে সেই অর্থই প্ৰবল এবং সভ্য ও বর্বর সকল দেশে সকল ভাবেই শক্তিপূজা চলছে- অন্যায় অসত্য সে পূজায় লজ্জিত নয়, লোভ তার লক্ষ্য এবং হিংসা তার পূজোপচার। এই লোভ মন্দ নয়, ভালোই, হিংস্ৰশক্তি মনুষ্যত্বের পক্ষে অত্যাবশ্যক এমন সকল তর্ক শক্তিপূজক য়ুরোপে স্পর্ধার সঙ্গে চলছে, য়ুরোপের ছাত্ররূপে আমাদের মধ্যেও চলছেসে-সম্বন্ধে আমার যা বলবার অন্যত্র বলেছি ; এখানে এইটুকু বক্তব্য যে, সাধারণ লোকের মনে শক্তিপূজার সঙ্গে একটি উলঙ্গ নিদারুণতর ভাব, নিজের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য বলপূর্বক দুর্বলকে বলি দেবার ভাব সংগত হয়ে আছে- “বাতায়নিকের পত্রে আমি তারই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তবু এ কথা স্বীকার করা উচিত যে, কোনো ধর্মসাধনার উচ্চ অর্থ যদি দেশের কোনো বিশেষ শাস্ত্র বা সাধকের মধ্যে কথিত বা জীবিত থাকে। তবে তাকে সম্মান করা কর্তব্য । এমন-কি, ভুরিপরিমিত প্রচলিত ব্যবহারের চেয়েও তাকে বড়ো বলে জানা চাই। ধর্মকে পরিমাণের দ্বারা বিচার না করে তার উৎকর্ষের দ্বারা বিচার করাই শ্ৰেয় ||- স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ । কার্তিক ১৩২৬ সত্যের আহবান পরাসক্ত কীট বা জন্তু পরের রস রক্ত শোষণ করে বঁাচে ; খাদ্যকে নিজের শক্তিতে নিজ দেহের উপকরণে পরিণত করবার দেহযন্ত্র তাদের বিকল হয়ে যায় ; এমনি করে শক্তিকে অলস করবার পাপে প্রাণিলোকে এই সকল জীবের অধঃপতন ঘটে । মানুষের ইতিহাসেও এই কথা খাটে । কিন্তু পরাসক্ত মানুষ বলতে কেবল যে পরের প্রতি জড়ভাবে আসক্ত মানুষকেই বোঝায় তা নয়। চিরদিন যা চলে আসছে তার সঙ্গে যে আপনাকে জুড়ে রেখে দেয়, প্ৰচলিতের স্রোতের টানে যে হালছাড়া ভাবে আত্মসমপণ করে, সেও পরাসক্ত । কেননা বাহির আমাদের অন্তরের পক্ষে পর, সে যখন কেবল অভ্যাসের তাগিদে আমাদের চালিয়ে নিয়ে যায়। তখন আমাদের পরাসক্ত অন্তর নিরুদ্যম হয়ে ওঠে এবং মানুষের পরে অসাধ্যসাধন করবার যে-ভার আছে সে সিদ্ধ হয় না । এই হিসাবে জন্তুরা এ জগতে পরাসক্ত । তারা প্ৰচলিতের ধারায় গা-ভাসান দিয়ে চলে । তারা প্রাকৃতিক নির্বাচনের শাসনে বঁাচে মরে, এগোয় বা পিছোয় । এইজনেই তাদের অন্তঃকরণটা বাড়তে পারল না, বেটে হয়ে রইল । লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে মৌমাছি যে চাক তৈরি করে আসছে সেই চাক তৈরি করার একটানা ঝোক কিছুতেই সে কাটিয়ে বেরতে পারছে না । এতে করে তাদের চাক নিখুঁত-মতো তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তাদের অন্তঃকরণ এই চিরাভ্যাসের গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ হয়ে আছে, সে আপনাকে নানা দিকে মেলে দিতে পারছে না। এই সকল জীবের সম্বন্ধে প্ৰকৃতির যেন সাহসের অভাব দেখতে পাই । সে এদের নিজের আঁচলে ঢেকে চালায়, পাছে নিজে চলতে গেলে বিপদ বাধিয়ে বসে- এই ভয়ে এদের অন্তরের চলৎশক্তিকে ছেটে রেখে দিয়েছে । কিন্তু সৃষ্টিকর্তার জীবরচনা-পরীক্ষায় মানুষের সম্বন্ধে হঠাৎ খুব একটা সাহস দেখতে পাওয়া যায়। তিনি তার অন্তঃকরণটাকে বাধা দিলেন না। বাহিরে প্রাণীটিকে সর্বপ্রকারে বিবন্ত্র নিরন্ত্র দুর্বল করে এর অন্তঃকরণকে ছেড়ে দেওয়া হল । এই মুক্তি পাওয়ার আনন্দে সে বলে উঠল- আমি অসাধ্য সাধন করব । অর্থাৎ যা চিরদিন হয়ে আসছে তাই যে চিরদিন হতে থাকবে সে আমি সাইব না, যা হয় না। তাও হবে সেইজন্যে মানুষ তার প্রথম যুগে যখন চার দিকে অতিকায় জন্তুদের বিকট নখদন্তের