পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর f @b”ዒ থেকে তার প্রতি সমস্ত মনপ্ৰাণ দিয়ে তাকিয়ে থাকি ! তেড়ে গিয়ে তার পায়ে দাঁত বসিয়ে দেওয়া সেও একটা তীব্ৰ আসক্তি, আর ভক্তিতে তার পা জড়িয়ে ধরা সেও তথৈবচ- তাকে চাই নে বললেও তার ধ্যানে আমাদের সমস্ত হৃদয় রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে, আর চাই বললে তো কথাই নেই । মায়া জিনিসটা অন্ধকারের মতো, বাইরের দিক থেকে কলের গাড়ি চালিয়েও তাকে অতিক্রম করতে পারি নে, তাকে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে চাইলে সাত সমুদ্র তেরো নদী শুকিয়ে যাবে । সত্য আলোর মতো, তার শিখাটা জ্বলাবামাত্র দেখা যায় মায়া নেই । এইজন্যেই শাস্ত্রে বলেছেন ; স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ । ভয় হচ্ছে মনের নাস্তিকতা, তাকে না।’এর দিক থেকে নিকেশ করা যায় না, উপস্থিতমত তার একটা কারণ গেলেও রক্তবীজের মতো আর-একটা কারণরূপে সে জন্ম নেয় । ধর্ম হচ্ছে সত্য, সে মনের আস্তিকতা, তার অল্পমাত্র আবির্ভাবে ই প্ৰকাণ্ড না'কে একেবারে মূলে গিয়ে অভিভূত করে । ভারতে ইংরেজের আবির্ভাব-নামক ব্যাপারটি বহুরূপী ; আজ সে ইংরেজের মূর্তিতে, কাল সে অন্য বিদেশীর মূর্তিতে এবং তার পরদিন সে নিজের দেশী লোকের মূর্তিতে নিদারুণ হয়ে দেখা দেবে । এই পরতন্ত্রতাকে ধনুর্বাণ হাতে বাইরে থেকে তাড়া করলে সে আপনার খোলস বদলাতে বদলাতে আমাদের হয়রান করে তুলবে । কিন্তু আমার দেশ আছে এইটি হল সত্য, এইটিকে পাওয়ার দ্বারা বাহিরের মায়া। আপনি নিরস্ত হয় । আমার দেশ আছে। এই আস্তিকতার একটি সাধনা আছে । দেশে জন্মগ্রহণ করেছি বলেই দেশ আমার, এ হচ্ছে সেই-সব প্রাণীর কথা যারা বিশ্বের বাহ্যব্যাপার সম্বন্ধে পরাসক্ত । কিন্তু যেহেতু মানুষের যথার্থ স্বরূপ হচ্ছে তার আত্মশক্তিসম্পন্ন অন্তরপ্রকৃতিতে, এইজন্য যে দেশকে মানুষ আপনার জ্ঞানে বুদ্ধিতে প্রেমে কর্মে সৃষ্টি করে তোলে সেই দেশই তার স্বদেশ । ১৯০৫ খৃস্টাব্দে আমি বাঙালিকে ডেকে এই কথা বলেছিলেম যে, আত্মশক্তির দ্বারা ভিতরের দিক থেকে দেশকে সৃষ্টি করো, কারণ সৃষ্টির দ্বারাই উপলব্ধি সত্য হয় । * বিশ্বকর্ম। আপনি সৃষ্টিতে আপনাকেই লাভ করেন । দেশকে পাওয়ার মানে হচ্ছে দেশের মধ্যে আপনার আত্মাকেই ব্যাপক করে উপলব্ধি করা । আপনার চিন্তার দ্বারা, কর্মের দ্বারা, সেবার দ্বারা, দেশকে যখন নিজে গড়ে তুলতে থাকি তখনই আত্মাকে দেশের মধ্যে সত্য করে দেখতে পাই। মানুষের দেশ মানুষের চিত্তের সৃষ্টি, এইজন্যেই দেশের মধ্যে মানুষের আত্মার ব্যাপ্তি, আত্মার প্রকাশ । যে দেশে জন্মেছি কী উপায়ে সেই দেশকে সম্পূর্ণ আমার আপন করে তুলতে হবে বহুকাল পূর্বে “স্বদেশী সমাজ” নামক প্ৰবন্ধে তার বিস্তারিত আলোচনা করেছি । সেই আলোচনাতে যে-কোনো ক্রটি থাকুক এই কথাটি জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে যে, দেশকে জয় করে নিতে হবে। পরের হাত থেকে নয় নিজের নৈষ্কম্য থেকে, ঔদাসীন্য থেকে । দেশের যে-কোনো উন্নতি সাধনের জন্যে যে উপলক্ষে আমরা ইংরেজ-রাজসরকারের দ্বারস্থ হয়েছি সেই উপলক্ষেই আমাদের নৈষ্কম্যকে নিবিড়তর করে তুলেছি মাত্র । কারণ, ইংরেজ-রাজসরকারের কীর্তি আমাদের কীর্তি নয়, এইজন্য বাহিরের দিক থেকে সেই কীর্তিতে আমাদের যতই উপকার হােক, ভিতরের দিক থেকে তার দ্বারা আমাদের দেশকে আমরা হারাই, অর্থাৎ আত্মার মূল্যে সফলতা পাই । যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন : ন বা অরে পুত্ৰস্য কামায় পুত্ৰঃ প্রিয়ো ভবতি, আত্মনন্তু কামায় পুত্ৰঃ প্রিয়ো ভবতি । দেশ সম্বন্ধেও এই কথা খাটে । দেশ আমারই আত্মা, এইজন্যই দেশ আমার প্রিয়- এ কথা যখন জানি তখন দেশের সৃষ্টিকার্যে পরের মুখাপেক্ষা করা সহ্যই হয় না । আমি সেদিন দেশকে যে কথা বলবার চেষ্টা করেছিলুম। সে বিশেষ কিছু নতুন কথা নয় এবং তার মধ্যে এমন-কিছু ছিল না যাতে স্বদেশহিতৈষীর কানে সেটা কটু শোনায়। কিন্তু আর-কারও মনে না ৩ ‘আত্মশক্তি” গ্রন্থের প্রকাশ, আশ্বিন ১৩১২। রবীন্দ্র-রচনাবলীর তৃতীয় খণ্ড(সুলভ দ্বিতীয়)এবং ‘স্বদেশী সমাজ’ (১৩৬৯) দ্রষ্টব্য) । ৪। রবীন্দ্র-রচনাবলীর তৃতীয় খণ্ড (সুলভ দ্বিতীয়) দ্রষ্টব্য। অপিচ ‘স্বদেশী সমাজ’ (১৩৬৯) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত । Տ Հ||\ՉԵr