Ved NR রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মুশকিল। এই যে, রাজসংসারে ফরাসের কাজের প্রয়োজন আছে, কিন্তু রাজমন্ত্রীর পদেরই সম্মান । এমন-কি, যে স্থলে তার পদই আছে, কর্ম নেই, সেখানেও সে তার খেতাব নিয়ে মানের দাবি করে । ফরাস এ দিকে খেটে খেটে হয়রান হয়। আর মনে মনে ভাবে, তার প্রতি দৈবের অবিচার । পেটের দায়ে অগত্যা দীনতা স্বীকার করে, কিন্তু ক্ষোভ মেটে না । ইচ্ছার স্বাধীনতার স্বপক্ষে ভাগ্যও যদি যোগ দিত, সব ফরাসই যদি রাজমন্ত্রী হয়ে উঠত, তা হলে মন্ত্রণার কাজ যে ভালো চলত তা নয়, ফরাসের কাজও একেবারেই বন্ধ হয়ে যেত । দেখা যাচ্ছে, ফরাসের কাজ অত্যাবশ্যক, অথচ ফরাসের পক্ষে তা অসন্তোষজনক । এমন অবস্থার বাধ্য হয়ে কাজ করা অপমানকর । ভারতবর্ষ এই সমস্যার মীমাংসা করেছিল বৃত্তিভেদকে পুরুষানুক্রমে পাকা করে দিয়ে । রাজশাসনে যদি পাকা করা হত তা হলে তার মধ্যে দাসত্বের অবমাননা থাকত এবং ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহের চেষ্টা কখনোই থামত না । পাকা হল ধর্মের শাসনে । বলা হল, এক-একটা জাতির এক-একটা কাজ তার ধর্মেরই অঙ্গ । ধর্ম আমাদের কাছে ত্যাগ দাবি করে । সেই ত্যাগে আমাদের দৈন্য নয়, আমাদের গৌরব । ধর্ম আমাদের দেশে ব্ৰাহ্মণ শূদ্র সকলকেই কিছু-না-কিছু ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছে। ব্ৰাহ্মণকেও অনেক ভোগ বিলাস ও প্রলোভন পরিত্যাগ করবার উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, তার সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ প্রচুর সম্মান পেয়েছিল। না পেলে সমাজে সে নিজের কাজ করতেই পারত না । শূদ্রও যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে, কিন্তু সমাদর পায় নি । তবুও, সে কিছু পাক আর না পাক, ধর্মের খাতিরে হীনতা স্বীকার করার মধ্যেও তার একটা আত্মপ্ৰসাদ আছে | বস্তুত জীবিকানির্বাহকে ধর্মের শ্রেণীতে ভুক্ত করা তখনই চলে যখন নিজের প্রয়োজনের উপরেও সমাজের প্রয়োজন লক্ষ্য থাকে । ব্ৰাহ্মণ ভাতে-ভাত খেয়ে বাহ্য দৈন্য স্বীকার করে নিয়ে সমাজের আধ্যাত্মিক আদর্শকে সমাজের মধ্যে বিশুদ্ধ যদি রাখে। তবে তার দ্বারা তার জীবিকানির্বাহ হলেও সেটা জীবিকানির্বাহের চেয়ে বড়ো, সেটা ধর্ম। চাষী যদি চাষ না করে তবে একদিনও সমাজ টেকে না । অতএব চাষী আপন জীবিকাকে যদি ধর্ম বলে স্বীকার করে তবে কথাটাকে মিথ্যা বলা যায় না । অথচ এমন মিথ্যা সান্তনা তাকে কেউ দেয় নি যে, চাষ করার কাজ ব্ৰাহ্মণের কাজের সঙ্গে সম্মানে সমান । যে-সব কাজে মানুষের উচ্চতর বৃত্তি খাটে, মানবসমাজে স্বভাবতই তার সম্মান শারীরিক কাজের চেয়ে বেশি, এ কথা সুস্পষ্ট । যে দেশে জীবিকা-অৰ্জনকে ধর্মকর্মের সামিল করে দেখে না সে দেশেও নিম্নশ্রেণীর কাজ বন্ধ হলে সমাজের সর্বনাশ ঘটে । অতএব সেখানেও অধিকাংশ লোককেই সেই কাজ করতেই হবে । সুযোগের সংকীর্ণতাবশত সেরকম কাজ করবার লোকের অভাব ঘটে না, তাই সমাজ টিকে আছে । আজকাল মাঝে-মাঝে যখন সেখানকার শ্রমজীবীরা সমাজের সেই গরজের কথাটা মাথা নাড়া দিয়ে সমাজের নিষ্কর্ম বা পরাসক্ত বা বুদ্ধিজীবীদের জানান দেয় তখন সমাজে একটা ভূমিকম্প উপস্থিত হয়। তখন কোথাও-বা কড়া রাজশাসন, কোথাও-বা তাদের আর্জি-মঞ্জুরির দ্বারা সমাজরক্ষার চেষ্টা হয় । আমাদের দেশে বৃত্তিভেদকে ধর্মশাসনের অন্তর্গত করে দেওয়াতে এরকম অসন্তোষ ও বিপ্লবচেষ্টার গোড়া নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে করে জাতিগত কর্মধারাগুলির উৎকর্ষ সাধন হয়েছে কি না। ভেবে দেখবার বিষয় । যে-সকল কাজ বাহ্য অভ্যাসের নয়, যা বুদ্ধিমূলক বিশেষ ক্ষমতার দ্বারাই সাধিত হতে পারে, তা ব্যক্তিগত না হয়ে বংশগত হতেই পারে না । যদি তাকে বংশে আবদ্ধ করা হয় তা হলে ক্রমেই তার প্ৰাণ মরে গিয়ে বাইরের ঠাটটাই বড়ো হয়ে ওঠে । ব্ৰাহ্মণের যে সাধনা আন্তরিক তার জন্যে ব্যক্তিগত শক্তি ও সাধনার দরকার, যেটা কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক সেটা সহজ । আনুষ্ঠানিক আচার বংশানুক্ৰমে চলতে চলতে তার অভ্যাসটা পাকা ও দম্ভটা প্ৰবল হতে পারে, কিন্তু তার আসল জিনিসটি মরে যাওয়াতে আচারগুলি অর্থহীন বোঝা হয়ে উঠে। জীবনপথের বিঘ্ন ঘটায় । উপনয়নপ্ৰথা এক সময়ে