পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর - Vey সন্ধান করতে চায় । সেই আকাঙক্ষাই বৃহত্তর ভারতের প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে রূপ গ্ৰহণ করেছে । সেই আকাঙক্ষাই আপন প্ৰত্যাশা নিয়ে আমাকে অভিনন্দন করছে। এই প্ৰত্যাশা আমার চেষ্টাকে সার্থক করুক । বর্বরজাতীয় মানুষের প্রধান লক্ষণ এই যে, তার আত্মবোধ সংকীর্ণসীমাবদ্ধ । তার চৈতন্যের আলো উপস্থিত কাল ও বর্তমান অবস্থার ঘেরটুকুকেই আলোকিত করে রাখে বলে সে আপনাকে তার চেয়ে বড়ো ক্ষেত্রে জানে না । এইজন্যেই জ্ঞানে কর্মে সে দুর্বল। সংস্কৃত শ্লোকে বলে ; যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিৰ্ভবতি তাদৃশী । অর্থাৎ, ভাবনাই হচ্ছে সাধনার সৃষ্টিশক্তির মূলে । নিজের সম্বন্ধে, নিজের দেশ সম্বন্ধে বড়ো করে ভাবনা করবার দরকার আছে, নইলে কর্মে জোর পৌঁছয় না এবং অতি ক্ষীণ আশা ও অতি ক্ষুদ্র সিদ্ধি নিয়ে অকৃতাৰ্থ হতে হয় । নিজের কাছে নিজের পরিচয়টাকে বড়ো করবার চেষ্টাই সভ্যজাতির ইতিহাসগত চেষ্টা । নিজের পরিচয়কে সংকীর্ণ দেশকালের ভূমিকা থেকে মুক্তিদানই হচ্ছে এই চেষ্টার লক্ষ্য । যখন বালক ছিলুম ঘরের কোণের বাতায়নে বসে দেশের প্রাকৃতিক রূপকে অতি ছোটাে পরিধির মধ্যেই দেখেছি। বাইরের দিক থেকে দেশের এমন কোনো মূর্তি দেখি নি যার মধ্যে দেশের ব্যাপক আবির্ভাব আছে । বিদেশী বণিকের হাতে গড়া কলকাতা শহরের মধ্যে ভারতের এমন কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। যা সুগভীর ও সুদূরবিস্তৃত । সেই শিশুকালে কোণের মধ্যে অত্যন্ত বেশি অবরুদ্ধ ছিলাম বলেই ভারতবর্ষের বৃহৎ স্বরূপ চোখে দেখবার ইচ্ছা অত্যন্ত প্রবল হয়েছিল । এমন সময়ে আমার আট-নয় বছর বয়সে গঙ্গাতীরের এক বাগানে কিছু কালের জন্যে বাস করতে গিয়েছিলাম। গভীর আনন্দ পেলাম । গঙ্গানদী ভারতের একটি বৃহৎ পরিচয়কে বহন করে । ভারতের বহু দেশ বহু কাল ও বহু চিত্তের ঐক্যধারা তার স্রোতের মধ্যে বহমান । এই নদীর মধ্যে ভারতের একটি পরিচয়বাণী আছে। হিমাদ্রির স্কন্ধ থেকে পূর্বসমুদ্র পর্যন্ত লম্বমান এই গঙ্গানদী । সে যেন তার পর আর কয়েক বৎসর পরেই পিতা আমাকে সঙ্গে করে হিমালয় পর্বতে নিয়ে যান । আমার পিতাকে এই প্ৰথম নিকটে দেখেছি, আর হিমালয় পর্বতকে । উভয়ের মধ্যেই ভাবের মিল ছিল । হিমালয় এমন একটি চিরন্তন রূপ যা সমগ্ৰ ভারতের, স্যা এক দিকে দুৰ্গম, আর-এক দিকে সর্বজনীন । আমার পিতার মধ্যেও ভারতের সেই বিদ্যা-চিন্তায় পূজায় কর্মে প্রত্যহ প্ৰাণময় হয়ে দেখা যাচ্ছিল, যা সর্বকালীন, যার মধ্যে প্ৰাদেশিকতার কাপণ্যমাত্র নেই । তার পর অল্প বয়সে ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়তে শুরু করলাম । তখন আলেকজান্দার থেকে আরম্ভ করে ক্লাইভের আমল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতীয় ভারতবর্ষ বার বার কিরকম পরাস্ত অপমানিত হয়ে এসেছে এই কাহিনীই দিন ক্ষণ তারিখ ও নামমালা-সমেত প্ৰত্যহ কণ্ঠস্থ করেছি । এই আগৌরবের ইতিহাসমরুতে রাজপুতদের বীরত্বকাহিনীর ওয়েসিস থেকে যেটুকু ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব তাই নিয়ে স্বজাতির মহত্ত্ব-পরিচয়ের দারুণ ক্ষুধা মেটাবার চেষ্টা করা হত । সকলেই জানেন, সে সময়কার বাংলা কাব্য নাটক উপন্যাস কিরকম দুঃসহ ব্যগ্রতায় টডের রাজস্থান দোহন করতে বসেছিল । এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, দেশের মধ্যে আমাদের পরিচয়-কামনা কিরকম উপবাসী হয়ে ছিল । দেশ বলতে কেবল তো মাটির দেশ নয়, সে যে মানবচরিত্রের দেশ । দেশের বাহ্য প্রকৃতি আমাদের দেহটা গড়ে বটে, কিন্তু আমাদের মানবচরিত্রের দেশ থেকেই প্রেরণা পেয়ে আমাদের চরিত্র গড়ে ওঠে । সেই দেশটাকে যদি আমরা দীন বলে জানি তা হলে বিদেশী বীরজাতির ইতিহাস পড়ে আমাদের দীনতাকে তাড়াবার শক্তি অস্তরের মধ্যে পাই নে । ঘরের কোণে আবদ্ধ থেকে ভারতের দৃশ্যরূপটিকে বড়ো করে দেখবার পিপাসা যেমন মনের মধ্যে প্রবল হয়েছিল, তেমনি তখনকার পাঠ্য ভারত-ইতিহাসের অগীেরব-অধ্যায়ের অন্ধকার কোণের মধ্যে বসে বসে ভারতের চারিত্রিক মহিমার বৃহৎ পরিচয় পাবার জন্য মনের মধ্যে একটা ক্ষুধার পীড়ন ছিল । বস্তুত এই অসহ্য ক্ষুধাই আমাদের মনকে তখন নানা হাস্যকর অত্যুক্তি ও অবাস্তবতা নিয়ে তৃপ্তির