পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

No No রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বপ্নমূলক উপকরণ-রচনায় প্রবৃত্ত করেছিল । আজও সেদিন যে একেবারে চলে গেছে তা বলতে পারি (~ | যে তারার আলো নিবে গেছে নিজের মধ্যেই সে সংকুচিত । নিজের মধ্যে একান্ত বদ্ধ থাকবার বাধ্যতাকেই বলে দৈন্য । এই দৈনের গণ্ডির মধ্যেও তার প্রতি-মুহুর্ত-গত কাজ হয়তো কিছু আছে, কিন্তু উদার নক্ষত্রমণ্ডলীর সভায় তার সম্মানের স্থান নেই । সে অজ্ঞাত, অখ্যাত, পরিচয়হীন । এই অপরিচয়ের অবমাননাই কারাবাসের মতো । এর থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় আলোকের দ্বারা । অর্থাৎ, এমন কোনো প্রকাশের দ্বারা যাতে করে বিশ্বের সঙ্গে তাকে যোগযুক্ত করে, এমন সত্যের দ্বারা যা নিখিলের আদরণীয় । আমাদের শাস্ত্ৰে বার বার বলেছে, যিনি নিজের মধ্যে সর্বভুতকে এবং সর্বভূতের মধ্যে নিজেকে জানেন তিনিই সত্যকে জানেন । অর্থাৎ অহংসীমার মধ্যে আত্মার নিরুদ্ধ অবস্থা আত্মার সত্য অবস্থা নয় । ব্যক্তিগত মানুষের জীবনের সাধনায় এ যেমন একটা বড়ো কথা, নেশনের ঐতিহাসিক সাধনাতেও সেইরকম । কোনো মহাজাতি কী করে আপনাকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে পারে এই তপস্যাই তার তপস্যা । যে পারলে না বিধাতা তাকে বর্জন করলেন । মানবসভ্যতার সৃষ্টিকার্যে তার স্থান হল না । রামচন্দ্র যখন সেতুবন্ধন করেছিলেন তখন কাঠবেড়ালিরও স্থান হয়েছিল সেই কাজে । সে তখন শুধু গাছের কোটরে নিজের খাদ্যান্বেষণে না থেকে আপনার ক্ষুদ্র শক্তি নিয়েই দুই তটভূমির বিচ্ছেদসমুদ্রের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজে যোগ দিয়েছিল । সীতাকে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করাই পৃথিবীতে সকল মহৎ সাধনার রূপক । সেই সীতাই ধর্ম ; সেই সীতা জ্ঞান, স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি ; সেই সীতা সুন্দরী ; সেই সীতা সর্বমানবের কল্যাণী । নিজের কোটরের মধ্যে প্রভূত খাদ্যসঞ্চায়ের ঐশ্বৰ্য নিয়ে এই কাঠবেড়ালির সার্থকতা ছিল না, কিন্তু সীতা-উদ্ধারের মহৎ কাজে সে যে নিজেকে নিবেদন করেছিল এইজনেই মানবদেবতা তার পিঠে আশীৰ্ব্বাদরেখা চিহ্নিত করেছিলেন । প্ৰত্যেক মহাজাতির পিঠে আমরা সেই চিহ্ন দেখতে চাই, সেই চিহ্নের দ্বারাই সে আপন কোটরকোণের অতীত নিত্যলোকে স্থান লাভ করে । ভারতবর্ষের যে বাণী আমরা পাই সে বাণী যে শুধু উপনিষদের শ্লোকের মধ্যে নিবদ্ধ তা নয় । ভারতবর্ষ বিশ্বের নিকট যে মহত্তম বাণী প্রচার করেছে তা ত্যাগের দ্বারা, দুঃখের দ্বারা, মৈত্রীর দ্বারা, আত্মার দ্বারা ; সৈন্য দিয়ে, অস্ত্ৰ দিয়ে, পীড়ন লুণ্ঠন দিয়ে নয়। গৌরবের সঙ্গে দসু্যাবৃত্তির কাহিনীকে বড়ো বড়ো অক্ষরে আপনি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সে অঙ্কিত করে নি । আমাদের দেশেও দিগবিজয়ের পতাকা হাতে পরজাতির দেশ জয় করবার কীর্তি হয়তো সেকালে অনেকে লাভ করে থাকবেন, কিন্তু ভারতবর্ষ অন্য দেশের মতো ঐতিহাসিক জপমালায় ভক্তির সঙ্গে তাদের নাম স্মরণ করে না । বীর্যবান দাসুদের নাম ভারতবর্ষের পুরাণে খ্যাত হয় নি । অহংকেই যে মানুষ পরম ও চরম সত্য বলে জানে সেই বিনাশ পায় ; সকল দুঃখ সকল পাপের মূল এই অহমিকায় । বিশ্বের প্রতি মৈত্রীভাবনাতেই এই অহংভাব লুপ্ত হয়, এই সত্যটি আত্মার আলোক । এই আলোকদীপ্তি ভারবর্ষ নিজের মধ্যে বদ্ধ রাখতে পারে নি । এই আলোকের আভাতেই ভারত আপন ভূখণ্ডসীমার বাইরে আপনাকে প্রকাশ করেছিল । সুতরাং এইটিই হচ্ছে ভারতের সত্য পরিচয় । এই পরিচয়ের আলোকেই যদি নিজের পরিচয়কে উজ্জবল করতে পারি তা হলেই আমরা ধন্য! আমরা যে ভারতবর্ষে জন্মলাভ করেছি। সে এই মুক্তিমন্ত্রের ভারতবর্ষে সে এই তপস্বীর ভারতবর্ষে । এই কথাটি যদি ধ্রুব করে মনে রাখতে পারি তা হলে আমাদের সকল কর্ম বিশুদ্ধ হবে, তা নির্মাণ করতে হবে না ! ক্ষুধা হলেই মানুষ অন্নের স্বপ্ন দেখে । আজকাল আমাদের দেশে পোলিটিকাল আত্মপরিচয়ের ক্ষুধাটাই নানা কারণে সব চেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে ; এইজন্যে নিরন্তর তারই ভোজটাই স্বপ্নে দেখছি। তার চেয়ে বডো কথাগুলিকেও অপ্রাসঙ্গিক বলে উপেক্ষা করবার তর্জন আজকাল প্ৰায় শোনা যায় ।