পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

कiढvgद्ध VYA কিন্তু এই পোলিটিকাল আত্মপরিচয়ের ধারা খুঁজতে গিয়ে বিদেশী ইতিহাসে গিয়ে পৌঁছতে হয় । সেই ব্যগ্রতার তাড়নায় আপনাকে স্বপ্নে-গড়া ম্যাট্রসিনি, স্বপ্নে-গড়া গারিবালডি, কাল্পনিক ওয়াশিংটন বলে ভাবনা করতে হয় । অর্থতিত্ত্বেও তাই ; এখানে আমাদের কারও কারও কল্পনা বলশেভিজম কারও সিন্ডিক্যালিজম কারও বা সোসালিজম-এর গোলকধাধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ-সমস্তই মরীচিকার মতো, ভারতবর্ষের চিরকালীন জমির উপরে নেই-আমাদের দুর্ভাগ্যতাপদগ্ধ হলে আমলের তুষার্ত দৃষ্টির উপরে স্বপ্ন রচনা করছে। এই স্বপ্ন-সিনেমার কোণে কোণে মাঝে মাঝে Made in Europe-এর মার্ক ঝলক মেরে এর কারখানাঘরের বৃত্তান্তটি জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । অজানা পথে অবাস্তবের পিছনে আমরা যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি সেখানে অভিভূতিবিহবলতার মধ্যে আমাদের নিজের পরিচয় নেই। অথচ, পূর্বেই বলেছি নিজের ব্যক্তিস্বরূপের সত্য পরিচয়ের ভিত্তির উপরেই আমরা সিদ্ধিকে গড়ে তুলতে পারি। পলিটিকস-ইকনমিকস এর বাইরেও আমাদের গৌরবলোক আছে, এ কথা যদি আমরা জানি। তবে সেইখানেই আমাদের ভবিষ্যৎকে আমরা সত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব । বিশ্বাসহীনের মতো নিজের সত্যে অশ্রদ্ধা করে হাওয়ায় হাওয়ায় আকাশকুসুম চাষ করবার চেষ্টা করলে ফল পাব না। ভারতবর্ষ যে কোনখানে সত্য, নিজের লোহার সিন্ধুকের মধ্যে তার দলিল সে রেখে যায় নি । ভারতবর্ষ যা দিতে পেরেছে তার দ্বারাই তার প্রকাশ। নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ যা তার কুলোয় নি। তাতেই তার পরিচয় । অন্যকে সত্য করে দিতে পারার মূলেই হচ্ছে অন্যকে আপন করে উপলব্ধি । আপন সীমার বাধা যে ভাঙতে পেরেছে বাইরের দুৰ্গম ভৌগোলিক বাধাও সে লঙঘন করতে পেরেছে। এইজন্যেই ভারতবর্ষের সত্যের ঐশ্বর্যকে জানতে হলে সমুদ্রপারে ভারতবর্ষের সুদূর দানের ক্ষেত্রে যেতে হয়। আজ ভারতবর্ষের ভিতরে বসে ধূলিকালুষিত হাওয়ার ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষকে যা দেখি তার চেয়ে স্পষ্ট ও উজ্জ্বল করে ভারতবর্ষের নিত্যকালের রূপ দেখতে পাব ভারতবর্ষের বাইরে CQS চীনে গেলাম, দেখলাম জাত হিসাবে তারা আমাদের থেকে সম্পূৰ্ণ আলাদা । নাকে চোখে ভাষায় ব্যবহারে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো মিলই নেই। কিন্তু তাদের সঙ্গে এমন একটি গভীর আত্মীয়তার যোগ অনুভব করা গেল। যা ভারতবষীয় অনেকের সঙ্গে করা কঠিন হয়ে উঠেছে। এই যোগ রাজশক্তির দ্বারা স্থাপন করা হয় নি, এই যোগ উদ্যত তরবারির জোরেও নয়, এই যোগ কাউকে দুঃখ দিয়ে নয়- নিজে দুঃখস্বীকার করে । অত্যন্ত পরের মধ্যেও। যে সত্যের বলে অত্যন্ত আত্মীয়তা স্বীকার করা সম্ভব হয়। সেই সত্যের জোরেই চীনের সঙ্গে সত্য ভারতের চিরকালের যোগবন্ধন বাধা হয়েছে। এই সত্যের কথা বিদেশী পলিটিকসের ইতিহাসে স্থান পায় নি বলে আমরা একে অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করি নে। কিন্তু একে বিশ্বাস করবার প্রমাণ ভারতের বাইরে সুদূর দেশে আজও রয়ে গেছে । জাপানে প্রতিদিনের ব্যবহারে জাপানির সুগভীর ধৈৰ্য, আত্মসংযম, তার রসবোধের বিচিত্র পরিচয়ে যখন বিস্মিত হতেছিলাম তখন এ কথা কতবার শুনেছি যে, এই সকল গুণের প্রেরণা অনেকখানি বৌদ্ধধর্মের যোগে ভারতবর্ষ থেকে এসেছে। সেই মূল প্রেরণা স্বয়ং ভারতবর্ষ থেকে আজ লুপ্ত প্ৰায় হল । সত্যের যে বন্যা একদিন ভারতবর্ষের দুই কুল উপচিয়ে দেশে দেশে বয়ে গিয়েছিল ভারতবর্ষের প্রবাহিণীতে আজ তা তলায় নেমে আসছে, কিন্তু তার জলসিঞ্চয় আজও দূরের নানা জলাশয়ে গভীর হয়ে আছে। এই কারণেই সেই সকল জায়গা আধুনিক ভারতবাসীর পক্ষে তীর্থস্থান । কেননা ভারতবর্ষের খুব পরিচয় সেই সব জায়গাতেই । মধ্যযুগে মুসলমান রাজশক্তির সঙ্গে হিন্দুদের ধর্মবিরোধ ঘটেছিল । সেই সময় ধারাবাহিকভাবে সাধুসাধকদের জন্ম হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকে মুসলমান ছিলেন, যারা আত্মীয়তার সত্যের দ্বারা ধর্মবিরোধের মধ্যে সেতুবন্ধন করতে বসেছিলেন। তারা পোলিটিশান ছিলেন না, প্রয়োজনমূলক পোলিটিকাল ঐক্যকে তারা সত্য বলে কল্পনাও করেন নি । তারা একেবারে সেই গোড়ায় গিয়েছিলেন