পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর V SRð অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এ কথা শুনে ভয় পাবার কারণ নেই ; কারণ অন্য দেশে মানুষ সাধনার দ্বারা যুগপরিবর্তন ঘটিয়েছে ; গুটির যুগ থেকে ডানা মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব ; যদি না আসি তবে, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায় । ইতি ৭ই আষাঢ় S\S) RI IFe SVð Sð व्षी মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী । নরসিমাজে নারীশক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি । এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্ৰাণকে বহন করে, প্ৰাণকে পোষণ করে । পৃথিবীকে জীবের বাসযোগ্য করবার জন্যে অনেক যুগ গেছে ঢালাই পেটাই করা মিস্ত্রির কাজে । সেটা আধখানা শেষ হতে না-হতেই প্রকৃতি শুরু করলেন জীবসৃষ্টি, পৃথিবীতে এল বেদনা। প্ৰাণসাধনার সেই আদিম বেদনা প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে, নারীর হৃদয়ে। জীবপালনের সমস্ত প্ৰবৃত্তিজাল প্ৰবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহমানের তন্তুতে তন্তুতে । এই প্রবৃত্তি স্বভাবতই চিত্তবৃত্তির চেয়ে হৃদয়বৃত্তিতেই স্থান পেয়েছে গভীর ও প্রশস্ত ভাবে । এই সেই প্রবৃত্তি নারীর মধ্যে যা বন্ধনজাল গাথছে নিজেকে ও অন্যকে ধরে রাখবার জন্যে প্রেমে, মেহে, সকরুণ ধৈৰ্যে । মানবসংসারকে গড়ে তোলবার, বেঁধে রাখবার এই আদিম বাধুনি । এই সেই সংসার যা সকল সমাজের সকল সভ্যতার মূলভিত্তি । সংসারের এই গোড়াকার বঁাধন না থাকলে মানুষ ছড়িয়ে পড়ত আকারপ্রকারহীন বাম্পের মতো ; সংহত হয়ে কোথাও মিলনকেন্দ্ৰ স্থাপন করতে পারত না । সমাজবন্ধনের এই প্ৰথম কাজটি মেয়েদের । প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টিপ্রক্রিয়া গভীর গোপন, তার স্বতঃপ্রবর্তনা দ্বিধাবিহীন । সেই আদিপ্রাণের সহজ প্রবর্তনা নারীর স্বভাবের মধ্যে । সেইজন্য নারীর স্বভাবকে মানুষ রহস্যময় আখ্যা দিয়েছে। তাই অনেক সময়ে অকস্মাৎ নারীর জীবনে যে সংবেগের উচ্ছাস দেখতে পাওয়া যায় তা তর্কের অতীততা প্রয়োজন-অনুসারে বিধিপূর্বক খনন করা জলাশয়ের মতো নয়, তা উৎসের মতো যার কারণ আপনি অহৈতুক রহস্যে নিহিত । প্রেমের রহস্য, মেহের রহস্য অতি প্ৰাচীন এবং দুৰ্গম । সে আপনি সার্থকতার জন্যে তর্কের অপেক্ষা রাখে না। যেখানে তার সমস্যা সেখানে তার দ্রুত সমাধান চাই। তাই গৃহে নারী যেমনি প্রবেশ করেছে। কোথা থেকে অবতীর্ণ হল গৃহিণী, শিশু যেমনি কোলে এল মা তখনই প্ৰস্তুত । জীবরাজ্যে পরিণত বুদ্ধি এসেছে অনেক পরে। সে আপন জায়গা খুঁজে পায় সন্ধান করে, যুদ্ধ করে । দ্বিধা মিটিয়ে চলতে তার সময় যায়। এই দ্বিধার সঙ্গে কঠিন দ্বন্দ্বেই সে সবলতা ও সফলতা লাভ করে । । এই দ্বিধাতরঙ্গের ওঠাপড়ায় শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে যায়, সাংঘাতিক ভ্ৰম জমে উঠে বার বার মানুষের ইতিহাসকে দেয় বিপর্যন্ত করে । পুরুষের সৃষ্টি বিনাশের মধ্যে তলিয়ে যায়, নূতন করে বাধতে হয় তার কীর্তির ভূমিকা। পালটিয়ে পালটিয়ে পরীক্ষায় পুরুষের কর্ম কেবলই দেহপরিবর্তন করে । অভিজ্ঞতার এই নিত্যপরিক্রমণে যদি তাকে অগ্রসর করে তবে সে বেঁচে যায়, যদি ক্রটিসংশোধনের অবকাশ না পায় তবে জীবন-বাহনের ফাটল বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে তাকে টানে বিলুপ্তির কবলের মধ্যে । পুরুষের রচিত সভ্যতার আদিকাল থেকে এইরকম ভাঙা-গড়া চলছে। ইতিমধ্যে, নারীর মধ্যে প্ৰেয়সী, নারীর মধ্যে জননী-প্ৰকৃতির দীেত্যে স্থিরপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আপন কাজ করে চলেছে। এবং প্রবল আবেগের সংঘর্ষে আপন সংসারের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে অগ্নিকাণ্ড করেও আসছে । সেই প্ৰলয়া বেগ যেন বিশ্বপ্রকৃতির প্রলয়লীলারই মতো, ঝড়ের মতো, দাবীদাহের মতো- আকস্মিক, আত্মঘাতী ।