পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর আর আমরা আজ এই মৃত্যুশেলবিদ্ধ পশ্চিমের কাছ হইতে স্বাধীনতা ভিক্ষা করিবার জন্য ছুটাছুটি করিয়া আসিয়াছি। কিন্তু এই মুমূর্ষু আমাদিগকে কী দিতে পারে। পূর্বে এক রকমের রাষ্ট্রতন্ত্র ছিল, তাহার বদলে আর-এক রকমের রাষ্ট্রতন্ত্ৰ ? কিন্তু মানুষ কি কোনো সত্যকার বড়ো জিনিস। একের হাত হইতে অন্যের হাতে তুলিয়া লইতে পারে । মানুষ যে-কোনো সত্যসম্পদ লয় তাহা মনের ভিতরেই লয়, বাহিরে না । ভিক্ষার দানে আমরা স্বাধীন হইব না- কিছুতেই না । স্বাধীনতা অন্তরের সামগ্ৰী । য়ুরোপ কেন আমাদিগকে মুক্তি দিতে পারে না। যেহেতু তাহার নিজের মন মুক্তি পায় নাই। তার লোভের অন্ত কোথায় । যে হাত দিয়া সে কোনো সত্যবস্তু দিতে পারে লোভে তাহার সে হাতকে বাধিয়া রাখিয়াছে- সত্য করিয়া তার দিবার সাধ্যই নাই, সে যে রিপুর দাস । যে মুক্ত সেই মুক্তি দান করে । যদি সে বিষয়বুদ্ধির পরামর্শ পাইয়া আমাদিগকে কিছু দিতে আসে। তবে সে নিজের দানকে নিজে কেবলই খণ্ডিত করিবে । এক হাত দিয়া যত দিবে। আর-এক হাত দিয়া তার চেয়ে বেশি হরণ করিবে । স্বার্থের দানকে পরীক্ষা করিয়া লইবার বেলা দেখিব তাহাতে এত ছিদ্র যে, সে আমাদিগকে ভাসাইয়া রাখিবে কি, তাহাকে ভাসাইয়া রাখাই শক্ত ! তাই এই কথা বলি, বাহিরের দিক হইতে স্বাধীনতা পাওয়া যায়, এমন ভুল যদি মনে আঁকড়িয়া ধরি তবে বড়ো দুঃখের মধ্যেই সে ভুল ভাঙিবে। ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইতে পারি নাই বলিয়াই অন্তরে বাহিরে আমাদের বন্ধন । যে হাত দিতে পারে। সেই হাতই নিতে পারে । আপনার দেশকে আমরা অতি সামান্যই দিতেছি, সেইজন্যই আপনার দেশকে পাই নাই । বাহিরের একজন আমার দেশকে হাতে তুলিয়া দিলেই তবে তাহাকে পাইব, এ কথা যে বলে সে লোক দান পাইলেও দান রাখিতে পরিবে না । আপনি লোককে দুঃখ দিই, অপমান করি, অবজ্ঞা করি, বঞ্চনা করি, বিশ্বাস করি না— সেইজন্যই আপন পর হইয়াছে, বাহিরের কোনো আকস্মিক কারণ হইতে নয় । য়িহুদি যখন পরাধীন ছিল তখন রোমের হাত হইতে দক্ষিণস্বরূপ তাহারা স্বাধীনতা পায় নাই । পরে এমন ঘটিয়াছে যে, য়িহুদি দেশছাড়া হইয়া বিদেশে ছড়াইয়া পড়িল । তাহার রাষ্ট্র নাই, রাষ্ট্রতন্ত্রও নাই। কিন্তু তাহার ইতিহাসে এইটেই সকলের চেয়ে গুরুতর কথা নয় । ইহার চেয়ে অনেক বড়ো কথা এই যে, তাহার কােছ হইতে প্রাণের বীজ উড়িয়া আসিয়া যুরোপকে নূতন মনুষ্যত্ব দান করিয়াছে। সে যাহা দিয়াছে তাহাতেই তাহার সার্থকতা । যাহা হারাইয়াছে, যাহা পায় নাই, সেটা সত্ত্বেও সে বড়ো, ইতিহাসে তাহার প্রমাণ হইয়াছে । বাহিরের পরিমাণে মানুষের পরিমাণ নহে, এ কথা আমরা বার বার ভুলি কিন্তু তবু ইহা বার বার মনে করিতে হইবে । চীনদেশকে যুরোপ অস্ত্রবলে পরাস্ত করিয়া তাহাকে বিষ খাওয়াইয়াছে, সেটা বড়ো কথা নয়। কিন্তু বড়ো কথা এই যে, ভারত একদিন বিনা অস্ত্রবলে চীনকে অমৃত পান করাইয়াছিল । ভারত আজ যদি সমুদ্রের তলায় ডুবিয়া যায়। তবু যাহা সে দান করিয়াছে তাহার জোরেই সে মানুষের চিত্তলোকে রহিল। যাহা সে ভিক্ষা করিয়াছিল, চুরি করিয়াছিল, স্তুপাকার করিয়াছিল, তাহার জোরে নয় । তপস্যার বলে আমরা সেই দানের অধিকার পাইব, ভিক্ষার অধিকার নয়, এ কথা যেন কোনো প্রলোভনে না ভুলি। মানুষ যেহেতু মানুষ এই হেতু বস্তুর দ্বারা সে বঁাচে না, সত্যের দ্বারাই সে বঁাচে । এই সত্যই তাহার যে ; তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে আয়নায়- তাহাকে জানিয়াই মানুষ মৃত্যুকে অতিক্রম করে, তাহার উদ্ধারের অন্য কোনো উপায় নাই । এই সত্যকে দান করিবার জন্য আমাদের উপর আহবান আছে। মন্টেগু্যর ডাক খুব বড়ো ডাক, আজ এই কথা বলিয়া ভারতের সভা হইতে সভায়, সংবাদপত্র হইতে সংবাদপত্রে, ঘোষণা চলিতেছে । কিন্তু এই ভিক্ষার ডাকে আমরা মানুষ হইব না । আমাদের পিতামহেরা অমরলোক হইতে আমাদের আহবান করিতেছেন, বলিতেছেন : তোমরা যে অমৃতের পুত্র এই কথা জানো এবং এই কথা জানাও ; মৃত্যুছায়াচ্ছন্ন পৃথিবীকে এই সত্য