পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

や28の রবীন্দ্র-রচনাবলী জাগরণ ; অর্থাৎ তাকে দিয়েছিলেন তার আপনি আত্মারই উপলব্ধি- তাতেই সব দেওয়া পূর্ণ হয় । আজ সমস্ত দেশ জুড়ে আমাদের যদি দৈন্য এসে থাকে তা হলে জানা চাই, তার মূল আছে আমাদের ভিতরের দিকে । সেই মূল দুৰ্গতির একটিমাত্র বাহ্য লক্ষণ বেছে নিয়ে দেশসুদ্ধ সকলে মিলে তার উপরে একটিমাত্র বাহ্যিক প্রক্রিয়া নিয়ে পড়লে শনিগ্ৰহ ভয় পান না । মানুষ পাথরের মতো জড়পদার্থ হলে বাইরে হাতুড়ি ঠিকে তার মূর্তি বদল করা যেত ; কিন্তু মানুষের মূর্তিতে বাহির থেকে দৈন্য দেখা দিলে ভিতরে প্রাণশক্তির দিকে মন দেওয়া চাই- হাতুড়ি চালাতে গেলে সেই প্ৰাণটার উপরেই ঘা পড়বে । একদিন মোগল-পাঠানের ধাক্কা যেই লাগল হিন্দুরাজত্বের ছোটাে ছোটাে আলগা পাটকেলের র্কাচা ইমারত চার দিক থেকে খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল। দেশে, তখন সুতোর অভাব ছিল না, কিন্তু সেই সুতো দিয়ে জড়িয়ে বেঁধে ভাঙন বন্ধ করা যায় নি। রাজার সঙ্গে তখন আর্থিক বিরোধ ছিল না, কেননা তার সিংহাসন ছিল দেশেরই মাটিতে । যেখানে ছিল গাছ তার পাকা ফল পড়ত সেইখানেই গাছতলায় । আজ আমাদের দেশে রাজা এক-আধজন নয়, একেবারে রাজার বন্যা ভারতের মাটি ধুয়ে তার ফসল ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে সমুদ্রপারে । জমি তাতে ফলও হারায়, উর্বরতাও হারায় । এবারকার এ আঘাতও যে ঠেকাতে পারি নি। তার কারণ এ নয় যে, আমাদের যথেষ্ট সুতো নেই ; কারণ এই যে, আমাদের মিল নেই, প্ৰাণ নেই । কেউ কেউ বলেন, মোগল-পাঠানের আমলে আমাদের নিঃশক্তি ছিল বটে, কিন্তু অন্নবস্ত্ৰও তো ছিল । নদীতে জলধারা যখন কম তখনো বাধ দিয়ে ছোটাে ছোটাে কুণ্ডে হাতের কাছে দিনের কাজ চালাবার মতো জল ধরে রাখা যায় । এ দিকে বাধ ভেঙেছে যে । বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে দেনাপাওনা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকি এমন দিন আর নেই, কখনো আসবেও না । তা ছাড়া সেরকম অবরোধই সব চেয়ে বড়ো দৈন্য। এমন অবস্থায় বিশ্বের সঙ্গে ব্যাপারের যোগ্য মনের শক্তি যদি না জাগাতে পারি, তা হলে ফসল খেয়ে যাবে অন্যে, তুষ পড়ে থাকবে আমাদের ভাগে । ছেলে-ভোলানো ছড়ায় বাংলাদেশে শিশুদেরই লোভ দেখানো হয় যে, হাত ঘুরোলে লাড়ু, পাবার আশা আছে ; কিন্তু কেবল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাত-চালানোর দ্বারা মনের নিশ্চলতার অভাব পূর্ণ হয়ে দৈন্য দূর হবে, স্বরাজ মিলবে, এমন কথা বয়ঃপ্ৰাপ্ত লোকদের বলা চলে না । বাইরের দারিদ্র্য যদি তাড়াতে চাই তা হলে অন্তরেরই শক্তি জাগাতে হবে বুদ্ধির মধ্যে, জ্ঞানের মধ্যে, সহযোগিতা-প্রবর্তক হৃদাতার মধ্যে । তর্ক উঠবে, কাজ বাইরের থেকেও মনকে তো নাড়া দেয় । দেয় বটে, কাজের মধ্যেই যদি মনের অভিমুখে কোনো একটা চিন্তার ব্যঞ্জনা থাকে । কেরানির কাজে এটা থাকে না, এ কথা আমাদের কেরানিগিরির দেশে সকলেই জানে। সংকীর্ণ অভ্যাসের কাজে বাহ্য নৈপুণ্যই বাড়ে, আর বদ্ধ মন ঘানির অন্ধ বলদের মতো অভ্যাসের চক্ৰ প্ৰদক্ষিণ করতে থাকে। এইজন্যেই, যে-সব কাজ মুখ্যত কোনো-একটা বিশেষ শারীরিক প্রক্রিয়ার পুনঃপুনঃ আবৃত্তি সকল দেশেই মানুষ তাকে অবজ্ঞা করেছে। কার্লাইল খুব চড়া গলায় dignity of labour প্রচার করেছেন ; কিন্তু বিশ্বের মানুষ যুগে যুগে তার চেয়ে অনেক বেশি চড়া গলায় indignity of labour সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিয়ে আসছে। যারা মজুরি করে তারা নিতান্ত দায়ে পড়েই সমাজের বা প্রভুর, প্রবলের বা বুদ্ধিমানের, লোভে বা শাসনে নিজেদের যন্ত্র বানিয়ে তোলে। তাদেরই মন্ত্র ; সর্বনাশে সমুৎপন্ন অর্ধাং ত্যজাতি পণ্ডিতঃ । অর্থাৎ, না খেয়ে যখন মরতেই বসেছে তখন মনটাকে বাদ দিয়েই হাত চালিয়ে পেট চালানো । তাই বলে মানুষের প্রধানতর অর্ধেকটা বাদ দেওয়াতেই তার dignity, এমন কথা বলে তাকে সাত্বনা দেওয়া তাকে বিদ্রুপ করা । বস্তুত পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকেই এই যন্ত্রীভবনের পঙ্গুতা থেকে বাচাবে কিসে, এইটেই হয়েছে মস্ত সমস্যা। আমার বিশ্বাস সব বড়ো সভ্যতাই হয় মরেছে নয় জীবনমৃত হয়েছে, অল্প লোকের চাপে বহু লোককে মন-মরা করে দেওয়াতেই। কেননা মনই মানুষের সম্পদ । মনোবিহীন মজুরির আন্তরিক অগীেরব থেকে মানুষকে কোনো বাহ্য সমাদরে বঁাচাতে পারা যায় না। যারা নিজের কাছেই নিজে ভিতর থেকে খাটাে হয়ে গেছে, অন্যেরা তাদেরই খাটাে করতে পারে। যুরোপীয়