পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর V8S সভ্যতায় বিজ্ঞানচর্চার সামনে যদি কোনো বড়ো নৈতিক সাধনা থাকে। সে হচ্ছে বাহ্য প্রকৃতির হাতের সবরকম মাির থেকে মানুষকে বাচানো, আর হচ্ছে মানুষেরই মনটাকে যন্ত্রে না বেঁধে প্ৰাকৃতিক শক্তিকেই যন্ত্রে বেঁধে সমাজের কাজ আদায় করা । এ কথা নিশ্চিত যে, বিজ্ঞানকে এক পাশে ঠেলে রেখে কেবল হাত চালিয়ে দেশের বিপুল দারিদ্র্য কিছুতে দূর হতে পারে না । মানুষের জানা এগিয়ে চলবে না,কেবল তার করাই চলতে থাকবে, মানুষের পক্ষে এত বড়ো কুলিগিরির সাধনা আর কিছুই নেই । একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, মানুষ যেদিন প্ৰথম চাকা আবিষ্কার করেছিল সেদিন তার এক মহা দিন । আচল জড়কে চক্রাকৃতি দিয়ে তার সচলত বাড়িয়ে দেবা মাত্র, যে বোঝা সম্পূর্ণ মানুষের নিজের কাধে ছিল তার অধিকাংশই পড়ল জড়ের কাধে । সেই তো ঠিক, কেননা জড়ই তো শূদ্র । তার বাহিরের প্রাণ অস্তরের প্রাণী, উভয়কেই রক্ষা করতে হবে । তাই জড়ের উপর তার বাহ্য কর্মভার যতটাই সে না চাপাতে পারবে, ততটাই চাপাতে হবে মানুষের উপর । সুতরাং ততটা পরিমাণেই মানুষকে জড় করে শূদ্র করে তুলতেই হবে, নইলে সমাজ চলবে না । এই সব মানুষকে মুখে dignity দিয়ে কেউ কখনোই dignity দিতে পারবে না । চাকা অসংখ্য শূদ্ৰকে শূদ্ৰস্তত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই চাকাই চরকায়, কুমোরের চাকে, গাড়ির তলায়, স্কুল সূক্ষ্ম নানা আকারে মানুষের প্রভূত ভার লাঘব করেছে। এই ভারলাঘবতার মতো ঐশ্বর্যের উপাদান আর নেই, এ কথা মানুষ বহুযুগ পূর্বে প্ৰথম বুঝতে পারলে যেদিন প্রথম চাকা ঘুরল । ইতিহাসের সেই প্ৰথম অধ্যায়ে যখন চরকা ঘুরে মানুষের ধন-উৎপাদনের কাজে লাগল ধন তখন থেকে চক্রবর্তী হয়ে চলতে লাগল, সেদিনকার চরকাতেই এসে থেমে রইল না । এই তথ্যটির মধ্যে কি কোনো তত্ত্ব নেই। বিষ্ণুর শক্তির যেমন একটা অংশ পদ্ম তেমনি আর-একটা অংশ চক্র । বিষ্ণুর সেই শক্তির নাগাল মানুষ যেই পেলে আমনি সে আচলতা থেকে মুক্ত হল । এই আচলতাই হচ্ছে মূল দারিদ্র্য । সকল দৈবশক্তিই অসীম, এইজন্য চলনশীল চক্রের এখনো আমরা সীমায় এসে ঠেকি নি । এমন উপদেশ যদি মেনে বসি যে, সুতো কাটার পক্ষে আদিমকালের চরকাই শেষ তা হলে বিষ্ণুর পূর্ণ প্ৰসন্নতা কখনোই পাব না, সুতরাং লক্ষ্মী বিমুখ হবেন । বিজ্ঞান মর্তলোকে এই বিষ্ণুচক্রের অধিকার বাড়াচ্ছে। এ কথা যদি ভুলি, তা হলে পৃথিবীতে অন্য যে-সব মানুষ চক্রীর সম্মান রেখেছে তাদের চক্রান্তে আমাদের মরতে হবে । 钴 বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মহাচক্রের যে বিরাট শক্তিরূপ দেখা যায় সেটাকে যখন ভুলি, যখন কোনো এক বিশেষ কালের বিশেষ চরকাকেই সুতো কাটবার চরম উপাদান রূপে দেখি ও অভ্যস্তভাবে ব্যবহার করি, তবে চরকা ভিতরের দিক থেকে আমাদের কাছে বোবা হয়ে থাকে, তখন যে চরকা মানুষকে একদিন শক্তির পথে ধনের পথে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে সে আর এগোবার কথা বলে না। কানের কাছে আওয়াজ করে না তা নয়, কিন্তু মনের সঙ্গে কথা কয় না । আমাকে কেউ কেউ বলেছেন, চরকা ছাড়া আর কোনো কাজ কোরো না এমন কথা তো আমরা বলি নে । তা হতে পারে, কিন্তু আর কোনো কাজ করো এ কথাও তো বলা হয় না । সেই না-বলাটাই কি প্রবল একটা বলা নয় । স্বরাজসাধনায় একটিমাত্র কাজের হুকুম অতি নির্দিষ্ট আর তার চার দিকেই নিঃশব্দত । এই নিঃশব্দতার পটভূমিকার উপরে চরকা কি অত্যন্ত মস্ত হয়ে দেখা দিচ্ছে না। বস্তুত সে কি এতই মন্ত । ভারতবর্ষের তেত্রিশ কোটি লোক স্বভাবস্বাতন্ত্র্যনির্বিচারে এই ঘূর্ণ্যমান চরকার কাছে যে যতটা পারে আপনি সময় ও শক্তির নৈবেদ্য সমর্পণ করবে- চরকার কি প্রকৃতই সেই মহিমা আছে। একই পূজাবিধিতে একই দেবতার কাছে সকল মানুষকে মেলবার জন্যে আজ পর্যন্ত নানা দেশে বারে বারে ডাক পড়ল। কিন্তু, তাও কি সম্ভব হয়েছে। পূজাবিধিই কি এক হল, না দেবতাই হল একটি । দেবতাকে আর দেবাৰ্চিনাকে সব মানুষের পক্ষে এক করবার জন্য কত রক্তপাত, কত নিষ্ঠুর অত্যাচার পৃথিবীতে চলে আসছে। কিছুতেই কিছু হল না, শুধু কি স্বরাজতীর্থের সাধনমন্দিরে একমাত্র চরকা-দেবীর কাছেই সকলের অর্ঘ্য এসে মিলবে । মানবধর্মের প্রতি এত অবিশ্বাস ? দেশের লোকের