পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8V রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আমার প্রতি যেমন ধৈর্য রক্ষা করেছেন আজও করবেন ; আচার্য রায়মশায়ও জনাদার নিরপেক্ষ মত-স্বাতন্ত্র্যাকে শ্রদ্ধা করেন, অতএব মাঝে মাঝে বক্তৃতাসভায় যদিচ মুখে তিনি আমাকে অকস্মাৎ তাড়না করে উঠবেন, তবু অস্তরে আমার প্রতি নিষ্করুণ হবেন না । আর, র্যারা আমার দেশের লোক, র্যাদের চিত্তস্রোত বেয়ে উপকার আর অপকার উভয়েরই কত স্মৃতি অতলের মধ্যে তলিয়ে গেল, তারা আজ আমাকে যদি ক্ষমা না করেন কাল সমস্তই ভুলে যাবেন । আর যদি-বা না ভোলেন, আমার কপালে তঁদের হাতের লাঞ্ছনা। যদি কোনোদিন নাও ঘোচে, তবে আজ যেমন আচার্য ব্ৰজেন্দ্রনাথকে লাঞ্ছনার সঙ্গী পেয়েছি। কালও তেমনি হয়তো এমন কোনো কোনো স্বদেশের অনাদৃত লোককে পাব র্যাদের দীপ্তি দ্বারা লোকনিন্দ নিন্দিত হয় । V S \ স্বরাজসাধন আমাদের দেশে বিজ্ঞ লোকেরা সংস্কৃত ভাষায় উপদেশ দিয়েছেন যে, যত খুশি কথায় বলো, লেখায় লিখো না । আমি এ উপদেশ মানি নি, তার ভূরি প্রমাণ আছে । কিছু পরিমাণে মেনেওছি, সে কেবল উত্তর লেখা সম্বন্ধে । আমার যা বলবার তা বলতে কসুর করি নে ; কিন্তু বাদ যখন প্রতিবাদে পৌঁছয় তখন কলম বন্ধ করি । যতরকম লেখার বায়ু আছে ছন্দে এবং আছন্দে সকলেরই প্রভাব আমার উপর আছে- কেবল উত্তরবায়ুটাকে এড়িয়ে চলি । মত বলে যে-একটা জিনিস আমাদের পেয়ে বসে সেটা অধিকাংশ স্থলেই বিশুদ্ধ যুক্তি দিয়ে গড়া নয়, তার মধ্যে অনেকটা অংশ আছে যেটাকে বলা যায় আমাদের মেজাজ । যুক্তি পেয়েছি বলে বিশ্বাস করি, সেটা অল্প ক্ষেত্ৰেই, বিশ্বাস করি বলেই যুক্তি জুটিয়ে আনি, সেইটেই অনেক ক্ষেত্রে । একমাত্র বৈজ্ঞানিক মতই খাটি প্রমাণের পথ দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছয় ; অন্য জাতের মতগুলো বারো-আনাই রাগ-বিরাগের আকর্ষণে ব্যক্তিগত ইচ্ছার কেন্দ্ৰকে প্ৰদক্ষিণ করতে থাকে । এ কথাটা খুবই খাটে, যখন মতটা কোনো ফললাভের উপর প্রতিষ্ঠিত, আর সেই লোভা যখন বহুসংখ্যক লোকের মনকে অধিকার করে । সেই বহু লোকের লোভকে উত্তেজিত করে তাদের তাড়া লাগিয়ে কোনো একটা পথে প্রবৃত্ত করতে যুক্তির প্রয়োজন হয় না ; কেবল পথটা খুব সহজ হওয়া চাই, আর চাই দ্রুত ফললাভের আশা । খুব সহজে এবং খুব শীঘ্ৰ স্বরাজ পাওয়া যেতে পারে, এই কথাটা কিছুদিন থেকে দেশের মনকে মাতিয়ে রেখেছে। গণমনের এইরকম ঝোড়ো অবস্থায় এ সম্বন্ধে কোনাে প্রশ্ন নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ উত্তর-প্রত্যুত্তর কেবলমাত্র বাগবিতণ্ডার সাইক্লোন আকার ধরে ; সেই হাওয়ায় পাল তুলে দিয়ে কোনো মতকে কোনো বন্দরে পৌঁছিয়ে দেওয়া সহজ নয় । বহুকাল থেকে আমাদের ধারণা ছিল স্বরাজ পাওয়া দুর্লভ ; এমন সময়ে যেই আমাদের কানে পৌঁছল যে, স্বরাজ পাওয়া খুবই সহজ এবং অতি অল্পদিনের মধ্যেই পাওয়া অসাধ্য নয় তখন এ সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে বিচার করতে লোকের রুচি রইল না । তামার পয়সাকে সন্ন্যাসী সোনার মোহর করে দিতে পারে এ কথায় যারা মেতে ওঠে তারা বুদ্ধি নেই বলেই যে মাতে তা নয়, লোভে পড়ে বুদ্ধি খাটাতে ইচ্ছে করে না বলেই তাদের এত উত্তেজনা । অল্প কিছুদিন হল, স্বরাজ হাতের কাছে এসে পৌচেছে বলে দেশের লোক বিচলিত হয়ে উঠেছিল । তার পরে মেয়াদ উত্তীৰ্ণ হয়ে গেলে কথা উঠল, শর্ত পালন করা হয় নি বলেই আমরা বঞ্চিত হয়েছি । এ কথা খুব অল্প লোকেই ভেবে দেখলেন যে, আমাদের সমস্যাই হচ্ছে শর্ত-প্ৰতিপালন নিয়ে । স্বরাজ পাবার শর্ত আমরা পালন করি নে বলেই স্বরাজ পাইনে, এ কথা তো স্বতঃসিদ্ধ। হিন্দ-মুসলমানে যদি আত্মীয়ভাবে মিলতে পারে তা হলে স্বরাজ পাবার একটা বড়ো ধাপ তৈরি হয়, কথাটা বলাই বাহুল্য ।