পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর VG S অভাব- আর সেই অভাবই যখন দেশের লোকের অন্নের অভাব, শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্যের অভাব, জ্ঞানের অভাব, আনন্দের অভাবের মূল হয়ে উঠেছে, তখন দেশের জনসংঘের এই চিত্তদৈন্যকে ছাড়িয়ে উঠে কোনো বাহ্য অনুষ্ঠানের জোরে এ দেশে স্বরাজ কায়েম হতে পারে, এ কথা একেবারেই অশ্রদ্ধেয় । ইংরেজিতে একটা কথা আছে, সিদ্ধিই সিদ্ধিকে টানে- তেমনি স্বরাজই স্বরাজকে আবাহন করে আনে । বিশ্বে বিধাতার যে অধিকার আছে সেই হচ্ছে তার স্বরাজ, অর্থাৎ বিশ্বকে সৃষ্টি করবার অধিকার । আমাদেরও স্বরাজ হচ্ছে সেই ঐশ্বৰ্য, অর্থাৎ আপন দেশকে আপনি সৃষ্টি করে তোলবার অধিকার । সৃষ্টি করার দ্বারাই তার প্রমাণ হয়, এবং তার উৎকর্ষসাধন হয়। বেঁচে থাকবার দ্বারাই প্রমাণ হয় যে আমার প্রাণ আছে। কেউ কেউ হয়তো বলতেও পারেন যে, সুতো কাটাও সৃষ্টি । তা নয় । তার কারণ, চরকায় মানুষ চরকারই অঙ্গ হয় ; অর্থাৎ যেটা কল দিয়ে করা যেত সে সেইটেই করে । সে ঘোরায় । কল জিনিসটা মনোহীন বলেই সে একা, নিজের বাইরে তার কিছুই নেই। তেমনি যে মানুষ সুতো কাটছে সেও একলা ; তার চরকার সূত্র অন্য কারও সঙ্গে তার অবশ্যযোগের সূত্র নয় । তার প্রতিবেশী কেউ যে আছে, এ কথা তার জানিবার কোনো দরকারই নেই । রেশমের পলু যেমন একান্তভাবে নিজের চার দিকে রেশমের সুতো বোনে, তারও কাজ সেইরকম । সে যন্ত্র, সে নিঃসঙ্গ, সে বিচ্ছিন্ন । কনগ্রেসের কোনো মেম্বর যখন সুতো কাটেন তখন সেইসঙ্গে দেশের ইকনমিকস-স্বর্গের ধ্যান করতেও পারেন, কিন্তু এই ধ্যানমস্ত্রের দীক্ষা তিনি অন্য উপায়ে পেয়েছেনচরকার মধ্যেই এই মন্ত্রের বীজ নেই। কিন্তু, নে মানুষ গ্রাম থেকে মারী দূর করবার উদযোগ করছে তাকে যদি-বা দুৰ্ভাগ্যক্রমে সম্পূর্ণ একলাও কাজ করতে হয়, তবু তার কাজের আদিতে ও অন্তে সমস্ত গ্রামের চিন্তা নিবিড়ভাবে যুক্ত । এই কাজের দ্বারাই নিজের মধ্যে সমগ্র গ্রামকে সে উপলব্ধি করে । গ্রামেরই সৃষ্টিতে তার সজ্ঞান আনন্দ । তারই কাজে স্বরাজসাধনার সত্যকার আরম্ভ বটে । তার পরে সেই কাজে যদি সমস্ত গ্রামের লোক পরস্পর যোগ দেয় তা হলেই বুঝব, গ্রাম নিজেকে নিজে সৃষ্টি করার দ্বারাই নিজেকে নিজে যথার্থীরাপে লাভ করবার দিকে এগোচ্ছে । এই লাভ করাকেই বলে স্বরাজলাভে । পরিমাণ হিসেবে কম হলেও সত্য হিসাবে কম নয় । অর্থাৎ শতকরা একশোর হারে লাভ না হলেও হয়তো শতকরা একের হারে লাভ ; এই লাভই শতকরা একশোর সগোত্র, এমন-কি সহোদর ভাই । যে গ্রামের লোক পরস্পরের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অন্ন-উপার্জনে আনন্দবিধানে সমগ্রভাবে সম্মিলিত হয়েছে সেই গ্রামই সমস্ত ভারতবর্ষের স্বরাজলাভের পথে প্ৰদীপ জেলেছে। তার পরে একটা দীপের থেকে আর-একটা দীপের শিখা জ্বালানো কঠিন হবে না ; স্বরাজ নিজেই নিজেকে অগ্রসর করতে থাকবে, চরকার যান্ত্রিক প্ৰদক্ষিণপথে নয়, প্ৰাণের আত্মপ্রবৃত্ত সমগ্রবৃদ্ধির পথে । আশ্বিন ১৩৩২ রায়তের কথা। শ্ৰীমান প্রমথনাথ চৌধুরী কল্যাণীয়েযু আমাদের শাস্ত্রে বলে, সংসারটা উর্ধব্যমূল অবাকশাখ । উপরের দিক থেকে এর শুরু, নীচে এসে ডালপালা ছড়িয়েছে ; অর্থাৎ নিজের জোরে দাড়িয়ে নেই, উপরের থেকে ঝুলছে । তোমার ‘রায়তের কথা” পড়ে আমার মনে হল যে, আমাদের পলিটিকসও সেই জাতের । কনগ্রেসের প্রথম উৎপত্তিকালে দেখা গেল, এই জিনিসটি শিকড় মেলেছে উপরওয়ালাদের উপর মহলে— কি আহার কি আশ্রয় উভয়েরই জন্যে এর অবলম্বন সেই উর্ধর্বলােকে । > °1}8、