পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○ じ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ভিতর দিয়ে স্বকীত হতে হতে জমিদার হয়ে ওঠে, তার মধ্যে শয়তানের সকল শ্রেণীর অনুচরেরই জটালা দেখতে পাবে । জাল, জালিয়াতি, মিথ্যা-মকদ্দমা, ঘর-জ্বালানো, ফসল-তছরূপ-- কোনো বিভীষিকায় তাদের সংকোচ নেই । জেলখানায় যাওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষা পাকা হয়ে উঠতে থাকে । আমেরিকায যেমন শুনতে পাই ছোটো ছোটো ব্যাবসাকে গিলে ফেলে বড়ো বড়ো ব্যাবসা দানবাকার হয়ে ওঠে, তেমনি করেই দুর্বল রায়তের ছোটাে ছোটাে জমি ছলে বলে কৌশলে আত্মসাৎ করে প্রবল রায়ত ক্ৰমে জমিদার হয়ে উঠতে থাকে । এরা প্ৰথম অবস্থায় নিজে জমি চাষ করেছে, নিজের গোরুর গাড়িতে মাল তুলে হাটে বেচে এসেছে, স্বাভাবিক চতুরতা ছাড়া অন্য চাষীর সঙ্গে এদের কোনো প্ৰভেদ ছিল না । কিন্তু, যেমনি জমির পরিধি বাডতে থাকে আমনি হাতের লাঙল খসে গিয়ে গদার আবির্ভাব হয় । পেটের প্রত্যন্তসীমা প্রসারিত হতে থাকে, পিঠের দিকে লাগে তাকিয়া, মুলুকের মিথ্যা মকদ্দমা-পরিচালনার কাজে পাসার জমে, আর তার দাবরাব-তর্জন-গর্জন-শাসনশোষণের সীমা থাকে না । বড়ো বড়ো জালের ফাক বড়ো, ছোটো মাছ তার ভিতর দিয়ে পালাবার পথ পায় ; কিন্তু ছোটাে ছোটাে জালে চুনোপুটি সমস্তই ছাকা পডে— এই চুনোপুটির ঝাক নিয়েই রায়ত । একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রতিকল আইনটাকেই নিজেব অনুকুল করে নেওয়া মকদ্দমার জুজুৎসু খেলা । আইনের যে আঘাত মারতে আসে সেই আঘাতের দ্বারাই উলটিয়ে মারা ওকালতি-কুস্তির মারাত্মক প্যাচ । এই কাজে বড়ো বড়ো পালোয়ান নিযুক্ত আছে । অতএব রায়ত যতদিন বুদ্ধি ও অর্থের তহবিলে সম্পন্ন হয়ে না। ওঠে। ততদিন “উচল’ আইনও তার পক্ষে ‘’অগাধ জলে’ পড়বার উপায় হবে । এ কথা বলতে ইচ্ছা করে না, শুনতেও ভালো লাগে না যে, জমি সম্বন্ধে রায়তের স্বাধীন ব্যবহারে বাধা দেওয়া কর্তব্য । এক দিক থেকে দেখতে গেলে ষোলো-আনা স্বাধীনতার মধ্যে আত্ম-অপকারের স্বাধীনতাও আছে । কিন্তু ততবড়ো স্বাধীনতার অধিকার তারই যার শিশুবুদ্ধি নয় । যে রাস্তায় সর্বদা মোটর-চলাচল হয় সে রাস্তায় সাবালক মানুষকে চলতে বাধা দিলে সেটাকে বলা যায় জুলুম ; কিন্তু অত্যন্ত নাবালককে যদি কোনো বাধা না দিই। তবে তাকে বলে অবিবেচনা | আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা তাতে বলতে পারি, আমাদের দেশে মূঢ় রায়তদের জমি অবাধে হস্তান্তর করবার অধিকার দেওয়া আত্মহত্যার অধিকার দেওয়া | এক সময়ে সেই অধিকার তাদের দিতেই হবে, কিন্তু এখন দিলে কি সেই অধিকারের কিছু বাকি থাকবে । তোমার লেখার মধ্যে এই অংশে আমার মনে যে সংশয় আছে তা বললেম | G আমি জানি, জমিদার নির্লেভ নয় । তাই রায়তের যেখানে কিছু বাধা আছে জমিদারের আয়ের জালে সেখানে মাছ বেশি আটক পড়ে । আমাদের দেশে মেয়ের বিবাহের সীমা সংকীর্ণ, সেই বাধাটাই বরপক্ষের আয়ের উপায় । এও তেমনি । কিন্তু দেখতে দেখতে চাষীর জমি সরে সরে মহাজনের হাতে পড়লে আখেরে তাতে জমিদারের লোকসান আছে বলে আনন্দ করবার কোনো হেতু নেই । চাষীর পক্ষে জমিদারের মুষ্টির চেয়ে মহাজনের মুষ্টি অনেক বেশি কড়া— যদি তাও না মান এটা মানতে হবে, সেটা আর-একটা উপরি মুষ্টি । রায়তের জমিতে জমাবৃদ্ধি হওয়া উচিত নয়, এ কথা খুব সত্য | রাজসরকারের সঙ্গে দেনা-পাওনায় জমিদারের রাজস্ব বৃদ্ধি নেই, অথচ রায়তের স্থিতিস্থাপক জমায় কমা সেমিকোলন চলবে, কোথাও দাড়ি পড়বে না, এটা ন্যায়বিরুদ্ধ । তা ছাড়া এই ব্যবস্থাটা জমির উন্নতিসাধন সম্বন্ধে স্বাভাবিক উৎসাহের একটা মস্ত বাধা ; সুতরাং কেবল চাষী নয়, সমস্ত দেশের পক্ষে এটাতে অকল্যাণ । তা ছাড়া গাছ কাটা, বাসস্থান পাকা করা, পুষ্করিণীখনন প্রভৃতির অন্তরায়গুলো কোনোমতেই সমর্থন করা চলে না ।