পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর ○○ ふ তখন বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এত প্ৰবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য! কিন্তু, এত বড়ো আবেগ শুধু হিন্দুসমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল, মুসলমানসমাজকে স্পর্শ করল না ! সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয় নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীব করে রেখেছি । সেটাকে রক্ষা করেও লাফ দিয়ে সেটা পার হতে হবে, এমন আবদার চলে না । এমন কথা উঠতে পারে যে, ডোবা তো সনাতন ডোবা, কিন্তু আজ তার মধ্যে যে দুশ্চিকিৎস্য বিভ্ৰাট ঘটছে সেটা তো নূতন, অতএব হাল আমলের কোনো একটা ভূত আমাদের ঘাড় ভাঙবার গোপন ফন্দি করেছে, ডোবার কোনো দোষ নেই— ওটা ব্ৰহ্মার বুড়ো আঙুলের চাপে তৈরি । একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, ভাঙা গাড়িকে যখন গাড়িখানায় রাখা যায়। তখন কোনো উপদ্রব হয় না । সেটার মধ্যে শিশুরা খেলা করতে পারে, চাই কি মধ্যাহ্নের বিশ্রামবাসও হতে পারে । কিন্তু, যখনই তাকে টানতে যাই তখন তার জোড়ভাঙা অংশে অংশে সংঘাত উপস্থিত হয় । যখন চলি নি, রাষ্ট্রসাধনার পথে পাশাপাশি রয়েছি, গ্রামের কর্তব্য পালন করেছি, তখন তো নাড়া খাই নি । আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্ৰথম প্ৰবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তার বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন । যখন জিজ্ঞেস করলেম “এ কেন তখন জবাব পেলেম, যে-সব সম্মানী মুসলমান প্ৰজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা । এক তক্তপোশে বসাতে হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক । এ প্রথা তো অনেকদিন ধরে চলে এসেছে ; অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে, হিন্দুও মেনে এসেছে । জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে । তার পর ওদের ডেকে একদিন বলেছি, “আমরা ভাই, তোমাকেও আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে ।” তখন হঠাৎ দেখি অপর পক্ষ লাল টকটকে নতুন ফেজ মাথায় দিয়ে বলে, আমরা পৃথক । আমরা বিস্মিত হয়ে বলি, রাষ্ট্র ব্যাপারে পরস্পর পাশে এসে দাড়াবার বাধাটা কোথায় । বাধা ঐ জাজিম-তোলা আসনে বহুদিনের মস্ত ফাকটার মধ্যে । ওটা ছোটো নয় । ওখানে অকৃলি অতল কালাপানি । বক্ততামঞ্চের উপর দাড়িয়ে চেচিয়ে ডাক দিলেই পার হওয়া যায় না । আজকের দিনে রাষ্ট্রশক্তির উদবোধন হয়েছে বলেই যত ভেদ, যত ফাক, সব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেইজন্যই মার খাচ্ছি । এই মার নানা রূপে আসে- কিন্তু, আজ বড়ো করে দেখা দিল। এই মহাপুরুষের মৃত্যুতে । মহাপুরুষেরা এই মারকে বক্ষে গ্রহণ করে এর একান্ত বীভৎসতার পরিচয় দেন । তাতেই আমাদের চৈতন্য হয় । এই-যে চৈতন্য এসেছে, রিপুর বশবর্তী হয়ে কি এই শুভ অবসরকে নষ্ট করব, না, শুভবুদ্ধিদাতাকে বলব, যেখানেই ভেদ ঘটিয়েছি সেখানেই পাপের বেদি গোথেছি, তার থেকেই বাচাও ! এই – যে রুদ্রবেশে পাপ দেখা দিল এ তো ভালোই হয়েছে এক ভাবে । আজকে না ভেবে উপায় নেই যে, কী করে একে চিরকালের মতো পরাভূত করা যেতে পারে । প্রশ্ন উঠতে পারে, আশু আমরা কোন উপায় অবলম্বন করব । সহসা এ প্রশ্নের একটা পাকারকম উত্তর দিই এমন শক্তি আমার নেই । পরীক্ষা-আরম্ভ করে ক্রমে ক্ৰমে সে উপায় একদিন পাবই । আজকে সেই পরীক্ষা-আরম্ভের আয়োজন | আজকে দেখতে হবে, আমাদের হিন্দুসমাজের কোথায় কোন ছিদ্র, কোন পাপ আছে, অতি নির্মমভাবে তাকে আক্রমণ করা চাই । এই উদ্দেশ্য মনে নিয়ে আজ হিন্দুসমাজকে আহবান করতে হবে ; বলতে হবে, পীড়িত হয়েছি আমরা, লজিত হয়েছি, বাইরের আঘাতের জন্য নয়, আমাদের ভিতরের পাপের জন্য ; এসো সেই পাপ দূর করতে সকলে মিলি । আমাদের পক্ষে এ বড়ো সহজ কথা নয় । কেননা, অস্তরের মধ্যে বহুকালের অভ্যস্ত ভেদবুদ্ধি, বাইরেও বহুদিনের গড়া অতি কঠিন ভেদের প্রাচীর । মুসলমান যখন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে মুসলমানসমাজকে ডাক দিয়েছে, সে কোনো বাধা পায় নি— এক ঈশ্বরের নামে ‘আল্লাহো আকবর’ বলে সে ডেকেছে। আর আজ আমরা যখন ডাকব “হিন্দু এসো।” তখন কে আসবে । আমাদের মধ্যে কত ছোটাে ছোটাে সম্প্রদায়, কত গণ্ডী, কত প্ৰাদেশিকতা- এ উৰ্ত্তীৰ্ণ হয়ে কে আসবে । কত বিপদ গিয়েছে । কই একত্র তো হই নি । বাহির