পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVS রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রবল। সেই গৌরববোধ সেদিন নানা আকারে আমাদের বাড়ির অন্তঃপ্রকৃতি ও বাইরের ব্যবহারকে অধিকার করেছে । তখনকার দিনে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক হিন্দুধর্মের প্রতি র্যাদের আস্থা বিচলিত হত, তাদের মনকে হয় যুরোপের অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশেষ ছাদের নাস্তিকতা অথবা খৃষ্টান-ধর্ম-প্রবণতা পেয়ে বসত। কিন্তু এ কথা সকলের জানা যে, সেকালে আমাদের পরিবারে ভারতেরই শ্রেষ্ঠ আদর্শের অনুসরণ করে ভারতের ধর্ম সংস্কার করবার উৎসাহ সর্বদা জাগ্রত ছিল । বলা বাহুল্য, বালককালে স্বভাবতই সেই উৎসাহ আমার মনকে একটি বিশেষ ভাবে দীক্ষিত করেছে। সেই ভাবটি এই যে, জীবনের যা-কিছু মহত্তম দান তার পূর্ণ বিকাশ আমাদের অন্তঃপ্রকৃতির মধ্য থেকেই । আমাদের স্বভাবসীমার বাইরে শ্রেষ্ঠ জিনিসের অভাব নেই, লোভনীয় পদার্থ অনেক আছে, সে-সমস্তকে আমরা গ্ৰহণ করতে পারি। নে যদি না আমাদের প্রকৃতির মধ্যে তাদের আত্মসাৎ করি } যখন আমরা বাইরের কিছুতে মুগ্ধ হই তখন লুব্ধ মন অনুকরণের মরীচিকা-বিস্তারের দ্বারা তাকে নেবার জন্যে ব্যগ্র হয় । অনুকরণ প্ৰায় অতিকরণে পৌঁছয় ; তাতে রঙ চড়াই বেশি, তার আওয়াজ হয় প্রবল, তার আস্ফালন হয় অত্যুগ্র, অত্যন্ত জোর করে নিজের কাছে প্ৰমাণ করতে চেষ্টা করি জিনিসটা আমারই– অথচ নানা দিক থেকে তার ভঙ্গুরতা তার আত্মবিরোধ প্ৰকাশ পেতে থাকে । বাইরের জিনিসকে যখন আপন অন্তরের করি তখন তার ভাবটা বজায় থাকতে পারে। তবু তার প্রকাশটা হয় নিজেৰ মতো । কিন্তু যতক্ষণ সেটা আমাদের বাইরে জোড়া থাকে, ভিতরে মিলে না যায়, ততক্ষণ সেটা হয মোটা কলমে দাগাবোলানো অক্ষরের মতো, মূলের চেয়ে আকারে বড়ো, কিন্তু একেবারে তার গায়ে গায় সংলগ্ন । তার থেকে স্বতন্ত্র হয়ে সে অক্ষর লেখকের আপনি বাক্যে লেখকের আপনি চিন্তিত ভাবকে লিপিবদ্ধ করতে পারে না । আমাদের রাষ্ট্ৰীয় চেষ্টায়, বাইরে থেকে, ইস্কুলে পড়ার বই থেকে আমরা যা পেয়েছি তা আমাদের প্রাণে সর্বাঙ্গীণ হয়ে ওঠে নি বলেই অনেক সময় তার বাইরের ছদটাকেই খুব আড়ম্বরের সঙ্গে রেখায় রেখায় মেলাবার গলদঘর্ম চেষ্টা করি— এবং সেই মিলটুকু ঘটিয়েই মনে করি, যা পাবার তা পেয়েছি, যা কবিবার তা করা হল । ‘সাধনা' পত্রিকায় রাষ্ট্রীয় বিষয়ে আমি প্রথম আলোচনা শুরু করি । তাতে আমি এই কথাটার উপরেই বেশি জোর দিয়েছি । তখনকার দিনে চোখ রাঙিয়ে ভিক্ষা করা ও গলা মোটা করে গবমেন্টকে জুজুর ভয় দেখানোই আমরা বীরত্ব বলে গণ্য করতেম। আমাদের দেশে পোলিটিকাল অধ্যবসায়ের সেই অবাস্তব ভূমিকার কথাটা আজকের দিনের তরুণেরা ঠিকমত কল্পনা করতেই পারবেন না । তখনকার পলিটিকসের সমস্ত আবেদনটাই ছিল। উপরওয়ালার কাছে দেশের লোকের কাছে একেবারেই না । সেই কারণেই প্ৰাদেশিক রাষ্ট্রসম্মিলনীতে, গ্ৰাম্যজনমণ্ডলীসভাতে, ইংরেজি ভাষায় বক্ততা করাকে কেউ অসংগত বলে মনে করতেই পারতেন না । রাজসাহী-সম্মিলনীতে নাটোরের পরলোকগত মহারাজা জগদিন্দ্ৰনাথের সঙ্গে চক্রান্ত করে সভায় বাংলাভাষা প্রবর্তন করবার প্রথম চেষ্টা যখন করি তখন উমেশচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় প্রভৃতি তৎসাময়িক রাষ্ট্রনেতারা আমার প্রতি একান্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কঠোর বিদ্রুপ করেছিলেন । বিদ্রুপ ও বাধা আমার জীবনের সকল কমেই আমি প্রচুর পরিমাণেই পেয়েছি, এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। পর বৎসর রুগণ শরীর নিয়ে ঢাকা-কনফারেনসেও আমাকে এই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হতে হয়েছিল ! আমার এই সৃষ্টিছাড়া উৎসাহ উপলক্ষে তখন এমনতরো একটা কানাকানি উঠেছিল যে, ইংরেজি ভাষায় আমার দখল নেই বলেই রাষ্ট্রসভার মতো অজায়গায় আমি বাংলা চালাবার উদযোগ করেছি। বাঙালির ছেলের পক্ষে যে গালি সব চেয়ে লজার সেইটেই সেদিন আমার প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছিল, অর্থাৎ ইংরেজি আমি জানি নে । এত বড়ো দুঃসহ লাঞ্ছনা। আমি নীরবে সহ্য করেছিলাম তার একটা কারণ, ইংরেজি ভাষা-শিক্ষায় বাল্যকাল থেকে আমি সত্যই অবহেলা করেছি ; দ্বিতীয় কারণ, পিতৃদেবের শাসনে তখনকার দিনেও আমাদের পরিবারে পরস্পর পত্র লেখা প্রভূতি ব্যাপারে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার অপমানজনক বলে গণ্য 交乏