পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VV8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পক্ষে সম্ভব । আমাদের দেশকে সম্পূর্ণভাবে কেউই কেড়ে নিতে পারে না, এবং সেই দেশকে বাইরে থেকে দয়া করে কেউ আমাদের হাতে তুলে দেবে এমন শক্তি কারও নেই । দেশের পরে নিজের স্বাভাবিক অধিকারকে যে পরিমাণে আমরা ত্যাগ করেছি। সেই পরিমাণেই অন্যে তাকে অধিকার করেছে ! এই চিন্তা করেই একদিন আমি ‘স্বদেশী সমাজ” নাম দিয়ে একটি বক্ততা করেছিলাম । তার মর্মকথাটা আর-একবার সংক্ষেপে বলবার প্রয়োজন আছে | চিরদিন ভারতবর্ষে এবং চীনদেশে সমাজতন্ত্রই প্ৰবল, রাষ্ট্রতন্ত্র তার নীচে । দেশ যথার্থভাবে আত্মরক্ষা করে এসেছে সমাজের সম্মিলিত শক্তিতে । সমাজই বিদ্যার ব্যবস্থা করেছে, তৃষিতকে জল দিয়েছে, ক্ষুধিতকে অন্ন, পূজার্থীকে মন্দির, অপরাধীকে দণ্ড, শ্ৰদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা ; গ্রামে গ্রামে দেশের চরিত্রকে রক্ষিত এবং তার শ্ৰীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে । দেশের উপর দিয়ে রাজ্য-সাম্রাজ্যের পরিবর্তন হয়ে গেল, স্বদেশী রাজায় রাজায় নিয়তই রাজত্ব নিয়ে হাত-ফেরাফেরি চলল, বিদেশী রাজারা এসে সিংহাসন-কাড়াকড়ি করতে লাগিল- লুন্ঠপট অত্যাচারও কম হল না— কিন্তু তবু দেশের আত্মরক্ষা হয়েছে যেহেতু সে আপনি কােজ আপনি করেছে, তার অন্নবস্ত্র ধর্মকর্ম সমস্তই তার আপনারই হাতে । এমনি করে দেশ ছিল দেশের লোকের, রাজা ছিল তার এক অংশে মাত্র, মাথার উপর যেমন মুকুট থাকে তেমনি । রাষ্ট্রপ্রধান দেশে রাষ্ট্ৰতন্ত্রের মধ্যেই বিশেষভাবে বদ্ধ থাকে দেশের মর্মস্থান । সমাজপ্রধান দেশে দেশের প্রাণ সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে থাকে । রাষ্ট্রপ্রধান দেশের রাষ্ট্রতন্ত্রের পতনে দেশের অধঃপতন, তাতেই সে মারা যায় । গ্রীস রোম এমনি করেই মারা গিয়েছে । কিন্তু চীন ভারত রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই সুদীর্ঘকাল আত্মরক্ষা করেছে— তার কারণ, সর্বব্যাপী সমাজে তার আত্মা প্রসারিত । পাশ্চাত্য রাজার শাসনে এইখানে ভারতবর্ষ আঘাত পেয়েছে । গ্রামে গ্রামে তার যে সামাজিক স্বরাজ পরিব্যাপ্ত ছিল রাজশাসন তাকে অধিকার করলে । যখন থেকে এই অধিকার পাকা হয়ে উঠল। তখন থেকে গ্রামে গ্রামে দিঘিতে গেল জল শুকিয়ে ; জীৰ্ণ মন্দিরে, শূন্য অতিথিশালায় উঠল। অশথ গাছ ; জাল-জালিয়াতি মিথ্যা-মকদ্দমাকে বাধা দেবার কিছু রইল না ; রোগে তাপে দৈন্যে অজ্ঞানে অধমে সমস্ত দেশ রসাতলে তলিয়ে গেল । সকলের চেয়ে বিপদ হল এই যে, দেশ দেশের লোকের কাছে কিছু চাইলে আর সাড়া পায় না । জলদান অন্নদান বিদ্যাদান সমস্তই সরকার-বাহাদুরের মুখ তাকিয়ে । এইখানেই দেশ গভীরভাবে আপনাকে হারিয়েছে। দেশের লোকের সঙ্গে দেশ যথার্থভাবে সেবার সম্বন্ধসূত্রে যুক্ত, সেইখানেই ঘটেছে মর্মান্তিক বিচ্ছেদ । আগে স্বরাজ পেলে তবে সেই স্বাভাবিক সম্বন্ধের কাজ চলতে থাকবে এ কথা বলাও যা আর আগে ধনলাভ হবে তার পরে ছেলে মাকে স্বীকার করবে। এ কথা বলাও তাই । দারিদ্র্যের মধ্যে স্বাভাবিক সম্বন্ধের কাজ চলা উচিত- বস্তুত সেই অবস্থায় সম্বন্ধের দাবি বাড়ে বৈ কমে না । ‘স্বদেশী সমাজে তাই আমি বলেছিলুম, ইংরেজ আমাদের রাজা কিংবা আর-কেউ আমাদের রাজা এই কথাটা নিয়ে বকবকি করে সময় নষ্ট না করে সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা, নিজের দেশকে নিজে সত্যভাবে অধিকার করবার চেষ্টা সর্বাগ্রে করতে হবে । দেশের সমস্ত বুদ্ধিশক্তি ও কর্মশক্তিকে সংঘবদ্ধ আকারে কেমন করে দেশে বিস্তীর্ণ করা যেতে পারে ‘স্বদেশী সমাজে’ আমি তারই আদর্শ ব্যাখ্যা করেছিলুম। খদ্দর-পরা দেশই যে সমগ্র দেশের সম্পূৰ্ণ আদর্শ এ কথা আমি কোনোমতেই মানতে পারি। নে ; যখন দেশের আত্মা সজাগ ছিল তখন সে যে কেবলমাত্র আপনি তাতে বোনা কাপড় আপনি পরেছে তা নয়, তখন তার সমাজে তার বহুধা শক্তি বিচিত্র সৃষ্টিতে আপনাকে সার্থক করেছে। আজ সমগ্রভাবেই সেই শক্তির দৈনা ঘটেছে, কেবলমাত্র চরকায় সুতো কাটবার শক্তির দৈন্য নয় । আজ আমাদের দেশে চরকালাঞ্ছন পতাকা উড়িয়েছি। এ যে সংকীর্ণ জড়শক্তির পতাকা, অপরিণত যন্ত্রশক্তির পতাকা, স্বল্পবল পণ্যশক্তির পতাকা— এতে চিত্তশক্তির কোনো আহবান নেই। সমস্ত জাতিকে মুক্তির পথে যে আমন্ত্রণ সে তো কোনো বাহ্য প্রক্রিয়ার অন্ধ পুনরাবৃত্তির আমন্ত্রণ হতে