পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালাস্তর VVG পারে না । তার জন্যে আবশ্যক পূৰ্ণ মনুষ্যত্বের উদবোধন- সে কি এই চরকা-চালনায় । চিন্তাবিহীন মৃঢ় বাহ্য অনুষ্ঠানকেই ঐহিক পারিত্রিক সিদ্ধিলাভের উপায় গণ্য করেই কি এতকাল জড়িত্বের বেষ্টনে আমরা মনকে কর্মকে আড়ষ্ট করে রাখি নি । আমাদের দেশের সব চেয়ে বড়ো দুৰ্গতিব কারণ কি তাই নয় । আজ কি আকাশে পতাকা উডিয়ে বলতে হবে, বুদ্ধি চাই নে, বিদ্যা চাই নে, প্রীতি চাই নে, পৌরুষ চাই নে, অন্তরপ্রকৃতির মুক্তি চাই নে, সকলের চেয়ে বড়ো করে একমাত্র করে চাই চোখ বুজে মনকে বুজিয়ে দিয়ে হাত চালানো, বহু সহস্ৰ বৎসর পূর্বে যেমন চালানো হয়েছিল তারই অনুবর্তন ক’রে । স্বরাজ-সাধনাযাত্রায় এই হল রাজপথ ? এমন কথা বলে মানুষকে কি অপমান করা হয় না । বস্তুত যখন সমগ্রভাবে দেশের বুদ্ধিশক্তি কর্মশক্তি উদ্যত থাকে তখন অন্য দেশ থেকে কাপড় কিনে পরলেও স্বরাজের মূলে আঘাত লাগে না । গাছের গোড়ায় বিদেশী সার দিলেই গাছ বিদেশী হয় না, যে মাটি তার স্বদেশী তার মূলগত প্ৰাধান্য থাকলে ভাবনা নেই। পৃথিবীতে স্বরাজী এমন কোনো দেশই নেই যেখানে অন্য দেশের আমদানি জিনিস বহুল পরিমাণে ব্যবহার না করে । কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গেই তারা নানা চেষ্টায় আপন শক্তিকেও সার্থক করছে- কেবল এক দিকে নয়, কেবল বণিকের মতো পণ্য-উৎপাদনে নয়, বিদ্যা-অৰ্জনে, বুদ্ধির আলোচনায়, লোকহিতে, শিল্পসাহিত্য-সৃষ্টিতে, মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশে । সে দিকে যদি আমাদের দেশে অভাব থাকে। তবে নিজের হাত দুটােকে মনোবিহীন কল-আকারে পরিণত করে আমরা যতই সুতো কাটি আর কাপড় বুনি আমাদের লজ্জা যাবে না, আমরা স্বরাজ পাব না । আমি প্রথম থেকে রাষ্ট্ৰীয় প্রসঙ্গে এই কথাই বারংবার বলেছি, যে কাজ নিজে করতে পাবি সে কাজ সমস্তই বাকি ফেলে, অন্যের উপরে অভিযোগ নিয়েই অহরহ কর্মহীন উত্তেজনার মাত্ৰা চড়িয়ে দিন কাটানোকে আমি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বলে মনে করি নে। আপন পক্ষের কথাটা সম্পূর্ণ ভুলে আছি বলেই অপর পক্ষের কথা নিয়ে এত অত্যন্ত অধিক করে আমরা আলোচনা করে থাকি । তাতে শক্তিহাস হয় । স্বরাজ হাতে পেলে আমরা স্বরাজের কাজ নির্বাহ করতে পারব, তার পরিচয় স্বরাজ পাবার আগেই দেওয়া চাই । সে পরিচয়ের ক্ষেত্র প্রশস্ত । দেশের সেবার মধ্যে দেশের প্রতি প্রীতির প্রকাশ কোনো বাহ্য অবস্থান্তরের অপেক্ষা করে না, তার নির্ভর একমাত্র আন্তরিক সত্যের প্রতি । আজ যদি দেখি সেই প্ৰকাশ অলস উদাসীন, তবে বাহিরের অনুগ্রহে বাহ্য স্বরাজ পেলেই অস্তরের সেই জড়তা দূর হবে এ কথা আমি বিশ্বাস করি নে। আগে আমাদের বাহিরের বাধা দূর হবে, তার পরে আমাদের দেশগ্ৰীতি অন্তরের বাধা ভেদ করে পরিপূর্ণ শক্তিতে দেশের সেবায় নিযুক্ত হবে, এমন আত্মবিড়ম্বনার কথা আমরা যেন না বলি । যে মানুষ বলে “আগে ফাউন্টেন-পেন পাব তার পরে মহাকাব্য লিখব।” বুঝতে হবে তার লোভ ফাউন্টেন-পেনের প্রতিই, মহাকাব্যের প্রতি নয় । যে দেশাত্মবোধী বলে, “আগে স্বরাজ পেলে তার পরে স্বদেশের কাজ করব তার লোভ পতাকা-ওড়ানো উদি-পরা স্বরাজের রঙকরা কাঠামোটার পরেই। একজন আর্টিস্টকে জানি, তিনি অনেক দিন থেকে বলে এসেছিলেন, “রীতিমত সটুডিয়ো আমার অধিকারে না পেলে আমি হাতের কাজ দেখাতে পারব না ।” তার স্টাডিয়ো জুটল, কিন্তু হাতের কাজ আজও এগোয় না । যতদিন স্ট্রডিয়ো ছিল না ততদিন ভাগ্যকে ও অন্য সকলকে কৃপণ বলে দোষ দেবার সুযোগ তার ছিল, স্টুডিয়ো পাবার পর থেকে তার হাতও চলে না, মুখও চলে না । স্বরাজ আগে আসবে, স্বদেশের সাধনা তার পরে, এমন কথাও তেমনিই সত্যহীন, এবং ভিত্তিহীন @ष्ठन् ग्रँड | অগ্রহায়ণ ১৩৩৬