পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী سرC b م\ মানুষের গৃঢ় দুস্থপ্রবৃত্তি এই-সকল ক্ষেত্রে বর্বরতার রসসম্ভোগের সুযোগ পায় । বেণী ধরে টেনে লাথি মারতে যারা অকুষ্ঠিত সেই-শ্রেণীয় রাজানুচর। এ দেশে নিঃসন্দেহ অনেক আছে । যে কারণে চীনে তাদের দেখেছি সেই কারণ এখানেও প্ৰবল ৷ সেই অবজ্ঞা এবং তার আনুষঙ্গিক নিষ্ঠুরতা স্থায়ীভাবে এ দেশের আবহাওয়াকে ব্যাধিগ্রস্ত করেছে, এ কথা আমরা অনুভব করি । এই প্রসঙ্গে আর-এক দিনের কথা আমি বলবি ; তখন শিলাইদহে ছিলাম । সেখানকার জেলেদেব আমি ভালোরকম করেই জানুতম | তাদের জীবিকা জলের উপর । ডাঙার অধিকার যেমন পাকা, জলের অধিকার তেমন নয় । জলের মালেকরা তাদের উপর যেমন তেমন অত্যাচার করতে পারত ! এই হিসাবে চাষীদের চেযেও জেলেরা অসহায় । একবার জলকলের কর্তার কর্মচারী এসে অনধিকারে কোনো নীেকা থেকে প্রচুর পরিমাণে মাছ তুলে নিল নিজের ডিঙিতে । এরকম ঘটনা সর্বদাই ঘাটত । অনায় সহ করে যাওয়াই যার পক্ষে বঁচবার সহজ উপায় এইবার সে সইতে পারল না, দিলে সেই কর্মচারীর কান কেটে । তার পরে রাত্রি তখন দু’পহর হবে, জেলেদের কাছ থেকে আমার বোটে লোক এল ; বললে, সমস্ত জেলেপাড়ায় পুলিস লেগেছে । বললে, কঠোর আচরণ থেকে আমাদের মেয়েদের ছেলেদের রক্ষা করুন | তখনই একটি ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দিলুম। সরকারি কাজে বাধা দেবার জন্যে নয, কেবল উপস্থিত থাকবার জন্যে । তার অন্য শক্তি নেই, কিন্তু ভদ্র ব্যবহারে আদর্শ আছে | উপস্থিতি-দ্বারা সেই আদর্শকে প্ৰকাশ করেই অন্যায়ের সে প্রতিবাদ করতে পারবে । আমাদের দেশের কারাবাসীদের সম্বন্ধেও তার বেশি আমাদের কিছু করবার নেই। আমরা জানাতে পারি কোনটা ভদ্র কোনটা ভদ্র নয়, মানবধর্মের দোহাই দিতে পারি । কিন্তু জানাব। কাকে, দোহাই দেব কার সামনে দাড়িয়ে । জানাতে হবে তাদেরই যারা বেণী ধরে টান দেবার দলে, যারা মধ্যবর্তী, যারা বিদেশী রাজ্যশাসনের আধারে স্বদেশীর প্রতি অসম্মান ভরে তুলতে কুষ্ঠিত হয় না । একটা কথা মনে রাখতে হবে, কোনো অপরাধীকে দণ্ড দেবার পর্বে আইনে বাধা অত্যন্ত সতর্ক বিচারের প্রণালী আছে । এই সভ্যনীতি আমরা পেয়েছি ইংরেজের কাছ থেকে । এই নীতির পরে আমাদের দাবি অভ্যস্ত হয়ে গেছে । এক সময়ে সরাসরি কাজির বিচার প্রচলিত ছিল । ব্যক্তিগত আন্দাজের উপর, পক্ষপাতের উপর যে বিচার-প্ৰণালীর ভিত্তি ছিল তাকে আমরা অশ্রদ্ধা করতে শিখেছি । এ কথা আজ আমাদের কাছে সহজ হয়েছে যে, অপরাধের অপবাদ-আরোপের পর থেকেই কোনো অভিযুক্তের প্রতি অন্যায় করা সহজ ছিল যে যুগে সে যুগের দণ্ডনীতি সভ্য আদর্শের ছিল না ; মানুষের স্বাধীনতার অধিকার তখন অনিশ্চিত ভিত্তিতে স্থাপিত ছিল । সভাদেশে এ কথাও স্বীকৃত হয়েছে যে, অপরাধের নিঃসংশয় প্রমাণের জন্য প্ৰমাণতত্ত্বের অনুশাসনের ভিতর দিয়ে বৈধ সাক্ষ্যের সন্ধান ও বিশ্লেষণের জন্য অভিজ্ঞ বিচারক ও বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর প্রয়োজন আছে । এই বিশ্বাসের 'পরে যদি আস্থা না রাখি তা হলে আইন-আদালতকে প্ৰকাণ্ড অপব্যয়ের খেলা বলতে হবে । এই ব্যবস্থার মধ্যে নির্বিশেষে সকল মানুষের পরে যে সম্মান আছে এতদিন ধরে সেই নীতিকে শ্রদ্ধা করতে শিখছি । এও জানি, এত সাবধান হয়েও অনেক ঘটনায় অপরাধের শেষ মীমাংসা হয় নি । বহু নির্দোষী দণ্ড ভোগ করেছে । তবু যদি স্থির হয় যে বিশেষ স্থলে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে গোপনে সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে আন্দাজে বিচার ও আশু শাস্তিদান অনিবার্য, তবে তা নিয়ে তর্ক করতে চাই নে, কিন্তু এ কথা বলতেই হবে এমন স্থলে শাস্তির পরিমাণ দুঃসহ না হওয়াই উচিত, এমন হওয়া চাই যাতে বিচারের ভুলে নিরপরাধের প্রতি শাস্তি অতি কঠোর হয়ে অনুতাপের কারণ না ঘটে । কেবলমাত্র বন্দীদশাই তো কম দুঃখকর নয়, তার উপরে শাসনের ঝালমসলা প্রচুর করে তুলে তার তীব্ৰতা বাড়িয়ে তোলাকে তো কোনোমতেই সভ্যনীতি বলতে পারি নে। ঝালমসলা যে কটুজাতীয়, বাহির থেকে তার আন্দাজ করতে পারি মাত্র । যখন বৈধ উপায়ে নিঃসন্দেহে দোষ-প্রমাণ-চেষ্টার অসুবিধা আছে বলে মনে করা হয়, অন্তত তখন এই সংশয়ের ক্ষেত্রে করুণার স্থান রাখা চাই ।