পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ » °ልዓ রাজা ইহা অপেক্ষা অনেক উচ্ছ্বসিত ভাষায় রানীর নিকট বিপিনের গুণগান করিয়াছেন ; কিন্তু অদ্য রানীর মুখের এইটুকুমাত্র প্রশংসা শুনিয়া তাহার মনে হইল, বিপিনটার ক্ষমতা যে পরিমাণে অবিবেচক লোকে তদপেক্ষ তাহাকে ঢের বেশি বাড়াইয়া থাকে। উহার চেহারাই বা কী, আর গলাই বা কী এমন। কিয়ংকাল পূর্বে তিনিও এই অবিবেচকশ্রেণীর মধ্যে ছিলেন ; হঠাৎ কী কারণে র্তাহার বিবেচনাশক্তি বাড়িয়া উঠিল। পরদিন হইতে বিপিনের আহারাদির সুব্যবস্থা হইল। বসন্তকুমারী রাজাকে কহিলেন, “বিপিনকে কাছারি ঘরে আমলাদের সহিত বাসা দেওয়া অন্যায় হইয়াছে। হাজার হউক, একসময়ে উহার অবস্থা ভালো ছিল।” রাজা কেবল সংক্ষেপে উড়াইয়া দিয়া কহিলেন, “হা: !” রানী অনুরোধ করিলেন, “খোকার অন্নপ্রাশন উপলক্ষে আর-একদিন থিয়েটার দেওয়া হউক।” রাজা কথাটা কানেই তুলিলেন না। একদিন ভালো কাপড় কেঁচানো হয় নাই বলিয়া রাজা পুটে চাকরকে ভংসন করাতে সে কহিল, "কী করিব, রানীমার আদেশে বিপিনবাবুর বাসন মাজিতে ও সেবা করিতেই সময় কাটিয়া যায়।” রাজা রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “ইস, বিপিনবাবু তো ভারি নবাব হইয়াছেন, নিজের বাসন বুঝি নিজে মাজিতে পারেন না।” বিপিন পুনর্মুষিক হইয়া পড়িল । রানী রাজাকে ধরিয়া পড়িলেন, সন্ধ্যাবেলায় তাহদের সংগীতালোচনার সময় পাশের ঘরে থাকিয়া পর্দার আড়ালে তিনি গান শুনিবেন, বিপিনের গান তাহার ভালো লাগে। রাজা অনতিকাল পরেই পূর্ববং অত্যন্ত নিয়মিত সময়ে শয়ন ভোজন আরম্ভ করিলেন । গানবাজনা আর চলে না। রাজা মধ্যাহ্নে জমিদারি-কাজ দেখিতেন। একদিন সকাল সকাল অন্তঃপুরে গিয়া দেখিলেন, রানী কী একটা পড়িতেছেন। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কী পড়িতেছ।” রানী প্রথমটা একটু অপ্রতিভ হইয়া কহিলেন, “বিপিনবাবুর একটা গানের থাত আনাইয়৷ দুটো-একটা গানের কথা মুখস্থ করিয়া লইতেছি ; হঠাৎ তোমার শখ মিটিয়া গিয়া আর তো গান শুনিবার জো নাই।” বহুপূর্বে শখটাকে সমূলে বিনাশ করিবার জন্য রানী যে বহুবিধ চেষ্টা করিয়াছিলেন সে কথা কেহ তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিল না।