পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ لاه لا নবীন মুখখানি কাস্তিচন্দ্রের মুগ্ধ চক্ষে আশ্বিনের আসন্ন আগমনীর একটি আনন্দচ্ছবি আঁকিয়া দিল। মন্দাকিনীতীরে তরুণ পার্বতী কখনো কখনো এমন হংসশিশু বক্ষে লইয়া আসিতেন, কালিদাস সে কথা লিখিতে ভুলিয়াছেন। এমন সময় হঠাৎ মেয়েটি ভীতক্রস্ত হইয়া কাদোর্কাদো মুখে তাড়াতাড়ি হাস-দুটিকে বুকে তুলিয়া লইয়া অব্যক্ত আর্তস্বরে ঘাট ত্যাগ করিয়া চলিল। কাস্তিচন্দ্র কারণসন্ধানে বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, তাহার একটি রসিক পারিষদ কৌতুক করিয়া বালিকাকে ভয় দেখাইবার জন্য হাসের দিকে ফাকা বন্দুক লক্ষ করিতেছে। কাস্তিচন্দ্র পশ্চাৎ হইতে বন্দুক কাড়িয়া লইয়৷ হঠাৎ তাহার গালে সশকে প্রকাণ্ড একটি চপেটাঘাত করিলেন, অকস্মাৎ রসভঙ্গ হইয়া লোকটা সেইখানে ধপ, করিয়া বসিয়া পড়িল। কাস্তি পুনরায় কামরায় আসিয়া বন্দুক সাফ করিতে লাগিলেন। সেইদিন বেল প্রহর-তিনেকের সময় গ্রামপথের ঘনচ্ছায়ার মধ্য দিয়া শিকারীর দল শস্যক্ষেত্রের দিকে চলিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে একজন বন্দুকের আওয়াজ করিয়া দিল। কিছু দূরে বঁাশঝাড়ের উপর হইতে কী একটা পাখি আহত হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে ভিতরের দিকে পড়িয়া গেল । কৌতুহলী কান্তিচন্দ্র পাখির সন্ধানে ঝোপঝাড় ভেদ করিয়া ভিতরে গিয়া দেখিলেন, একটি সচ্ছল গৃহস্থঘর, প্রাঙ্গণে সারি সারি ধানের গোলা। পরিচ্ছন্ন বৃহৎ গোয়ালঘরের কুলগাছতলায় বসিয়া সকালবেলাকার সেই মেয়েটি একটি আহত ঘুঘু বুকের কাছে তুলিয়া উচ্ছসিত হইয়। কাদিতেছে এবং গামলার জলে অঞ্চল ভিজাইয়৷ পাখির চঞ্চুপুটের মধ্যে জল নিংড়াইয়া দিতেছে। পোষা বিড়ালটা তাহার কোলের উপর দুই পা তুলিয়া উর্ধ্বমুখে ঘুঘুটির প্রতি উংস্থক দৃষ্টিপাত করিতেছে ; বালিকা মধ্যে মধ্যে তাহার নাসিকাগ্রভাগে তর্জনী-আঘাত করিয়া লুব্ধ জন্তুর অতিরিক্ত আগ্রহ দমন করিয়া দিতেছে । পল্লীর নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে একটি গৃহস্থপ্রাঙ্গণের সচ্ছল শাস্তির মধ্যে এই করুণচ্ছবি এক মুহূর্তেই কান্তিচন্দ্রের হৃদয়ের মধ্যে আঁকা হইয়া গেল। বিরলপল্লব গাছটির ছায়া ও রৌদ্র বালিকার ক্রোড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে ; অদূরে আহারপরিতৃপ্ত পরিপুষ্ট গাভী আলস্তে মাটিতে বসিয়া শৃঙ্গ ও পুচ্ছ -আন্দোলনে পিঠের মাছি তাড়াইতেছে ; মাঝে মাঝে বাশের ঝাড়ে ফিস্ ফিস্ কথার মতো নূতন উত্তরবাতাসের খস্র খস শব্দ উঠিতেছে। সেদিন প্রভাতে নদীতীরে বনের মধ্যে যাহাকে বনশ্রীর মতো দেখিতে হইয়াছিল, আজ মধ্যাহ্নে নিস্তব্ধ গোষ্ঠপ্রাঙ্গণচ্ছায়ায় তাহাকে স্নেহবিগলিত গৃহলক্ষ্মীটির মতো দেখিতে হইল । Em