পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ २88 করিল না। ইহাতে ভূপতি কিছু ক্ষুন্ন হইল। তবে কি চারু অমলকে ভালোবাসে না। অমল যতদিন উপস্থিত ছিল ততদিন চারু তাহাকে লইয়া আমোদ-আহ্নাদ করিল, আর যেই চলিয়া গেল অমনি তাহার সম্বন্ধে উদাসীন ! এইরূপ বিসদৃশ ব্যবহারে ভূপতির মনে খটকা লাগিল, সে ভাবিতে লাগিল— তবে কি চারুর হৃদয়ের গভীরতা নাই। কেবল সে আমোদ করিতেই জানে, ভালোবাসিতে পারে না ? মেয়েমানুষের পক্ষে এরূপ নিরাসক্ত ভাব তো ভালো নয়। চারু ও অমলের সখিত্বে ভূপতি আনন্দ বোধ করিত। এই দুইজনের ছেলেমানুষি আড়ি ও ভাব, খেলা ও মন্ত্রণ তাহার কাছে সুমিষ্ট কৌতুকাবহ ছিল ; অমলকে চারু সর্বদা যে যত্ন আদর করিত তাহাতে চারুর স্থকোমল হৃদয়ালুতার পরিচয় পাইয়৷ ভূপতি মনে মনে খুশি হইত। আজ আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিল, সে সমস্তই কি ভাসা-ভাসা, হৃদয়ের মধ্যে তাহার কোনো ভিত্তি ছিল না ? ভূপতি ভাবিল, চারুর হৃদয় যদি না থাকে তবে কোথায় ভূপতি আশ্রয় পাইবে । অল্পে অল্পে পরীক্ষা করিবার জন্ত ভূপতি কথা পাড়িল, “চারু, তুমি ভালো ছিলে তো ? তোমার শরীর খারাপ নেই ?” চারু সংক্ষেপে উত্তর করিল, “ভালোই আছি।” ভূপতি । অমলের তো বিয়ে চুকে গেল। এই বলিয়া ভূপতি চুপ করিল ; চারু তৎকালোচিত একটা কোনো সংগত কথা বলিতে অনেক চেষ্টা করিল, কোনো কথাই বাহির হইল না ; সে আড়ষ্ট হইয়৷ রহিল। ভূপতি স্বভাবতই কখনো কিছু লক্ষ্য করিয়া দেখে না— কিন্তু অমলের বিদায়শোক তাহার নিজের মনে লাগিয়া আছে বলিয়াই চারুর ঔদাসীন্ত তাহাকে আঘাত করিল। তাহার ইচ্ছা ছিল, সমবেদনায় ব্যথিত চারুর সঙ্গে আমলের কথা আলোচনা করিয়া সে হৃদয়ভার লাঘব করিবে । ভূপতি। মেয়েটিকে দেখতে বেশ — চারু, ঘুমোচ্ছ ? চারু কহিল, “না।” ভূপতি। বেচারা অমল একলা চলে গেল। যখন তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলুম, সে ছেলেমানুষের মতে কঁাদতে লাগল— দেখে এই বুড়োবয়সে আমি আর চোখের জল রাখতে পারলুম না। গাড়িতে দুজন সাহেব ছিল, পুরুষমানুষের কান্না দেখে তাদের ভারি আমোদ বোধ হল । নির্বাণদীপ শয়নঘরে বিছানার অন্ধকারের মধ্যে চারু প্রথমে পাশ ফিরিয়া শুইল,