পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

९१० রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘোষণা করিয়াছিল। কথা এই স্থির হইল, আমরা দুজনেই সেই কাগজে দুটা গল্প লিথিয়া পাঠাইব, দেখি কাহার ভাগ্যে পুরস্কার জোটে। রাত্রের ঘটনা তো এই। পরদিন প্রভাতের আলোকে বুদ্ধি যখন নির্মল হইয়া আসিল তখন দ্বিধা জন্মিতে লাগিল। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করিলাম, এ অবসর ছাড়িয়া দেওয়া হইবে না— যেমন করিয়া হউক, জিতিতেই হইবে । হাতে তখনো দুই মাস সময় ছিল । প্রকৃতিবাদ অভিধান কিনিলাম, বঙ্কিমের বইগুলাও সংগ্ৰহ করিলাম। কিন্তু বঙ্কিমের লেখা আমার চেয়ে আমার অন্তঃপুরে অধিক পরিচিত, তাই সে মহদাপ্রয় পরিত্যাগ করিতে হইল। ইংরেজি গল্পের বই দেদার পড়িতে লাগিলাম। অনেকগুলা গল্প ভাঙিয়া-চুরিয়া একটা প্লট দাড় করাইলাম। প্লটটা খুবই চমৎকার হইয়াছিল, কিন্তু মুশকিল এই হইল, বাংলা-সমাজে সে-সকল ঘটনা কোনো অবস্থাতেই ঘটিতে পারে না । অতি প্রাচীন কালের পাঞ্জাবের সীমান্তদেশে গল্পের ভিত্তি ফাদিলাম ; সেখানে সম্ভব-অসম্ভের সমস্ত বিচার একেবারে নিরাকৃত হওয়াতে কলমের মুখে কোনো বাধা রহিল না। উদাম প্রণয়, অসম্ভব বীরত্ব, নিদারুণ পরিণাম সার্কাসের ঘোড়ার মতো আমার গল্প ঘিরিয়া অদ্ভুত গতিতে ঘুরিতে লাগিল। রাত্রে আমার ঘুম হইত না ; দিনে আহারকালে ভাতের থালা ছাড়িয়া মাছের ঝোলের বাটিতে ডাল ঢালিয়া দিতাম। আমার অবস্থা দেখিয়া নিঝরিণী আমাকে অনুনয় করিয়া কহিল, “আমার মাথা খাও, তোমাকে আর গল্প লিখিতে হইবে না— আমি হার মানিতেছি।” আমি উত্তেজিত হইয়। বলিলাম, “তুমি কি মনে করিতেছ আমি দিনরাত্রি কেবল গল্প ভাবিয়াই মরিতেছি । কিছুই না । আমাকে মক্কেলের কথা ভাবিতে হয়— তোমার মতো গল্প এবং কবিতা চিন্তা করিবার অবসর পড়িয়া থাকিলে আমার ভাবনা की झिळ ।” যাহা হউক, ইংরেজি প্লট এবং সংস্কৃত অভিধানে মিলাইয়া একটা গল্প খাড়া করিলাম। মনের কোণে ধর্মবুদ্ধিতে একটু পীড়াবোধ করিতে লাগিলাম— ভাবিলাম, বেচার নিঝর ইংরেজি সাহিত্য পড়ে নাই, তাহার ভাব সংগ্ৰহ করিবার ক্ষেত্র সংকীর্ণ ; আমার সঙ্গে তাহার এই লড়াই নিতান্ত অসমকক্ষের লড়াই ।