পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ২৭৫ দমন করিয়া রাখে, সমাজে এমন কোনো শক্তি ছিল না । শাশুড়ির কাছেও সে কোনোদিন গাম্ভীর্য অবলম্বন করিতে পারে নাই। প্রথম-প্রথম তা লইয়। অনেক কথ। উঠিয়াছিল। কিন্তু, শেষকালে সকলকেই হার মানিয়া বলিতে হইল— ওর ওই রকম। তার পরে এমন হইল যে, পটলের জুনিবার প্রফুল্লতার আঘাতে গুরুজনদের গাম্ভীর্য ধূলিসাং হইয়া গেল। পটল তাহার আশেপাশে কোনোখানে মন-ভার মুখ-ভার দুশ্চিন্ত৷ সহিতে পারিত না— অজস্র গল্প-হাসি-ঠাট্রায় তাহার চারি দিকের হাওয়া যেন বিদ্যুৎশক্তিতে বোঝাই হইয়া থাকিত । পটলের স্বামী হরকুমারবাবু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট– বেহার-অঞ্চল হইতে বদলি হইয়া কলিকাতায় আবকারি-বিভাগে স্থান পাইয়াছেন। প্লেগের ভয়ে বালিতে একটি বাগানবাড়ি ভাড়া লইয়া থাকেন, সেখান হইতে কলিকাতায় যাতায়াত করেন। আবকারি-পরিদর্শনে প্রায়ই র্তাহাকে মফস্বলে ফিরিতে হইবে বলিয়া দেশ হইতে ম৷ এবং অন্য দুই-একজন আত্মীয়কে আনিবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময় ডাক্তারিতে নূতন-উত্তীর্ণ পসারপ্রতিপত্তিহীন যতীন বোনের নিমন্ত্রণে হগুখিানেকের জন্য এখানে আসিয়াছে। কলিকাতার গলি হইতে প্রথম দিন গাছপালার মধ্যে আসিয়া যতীন ছায়াময় নির্জন বারান্দায় ফাঙ্কন-মধ্যাহ্নের রসালস্তে আবিষ্ট হইয়া বসিয়া ছিল, এমন সময়ে পূর্বকথিত সেই উপদ্রব আরম্ভ হইল। পটল চলিয়া গেলে আবার খানিকক্ষণের জন্য সে নিশ্চিন্ত হইয়া একটুখানি নড়িয়া-চড়িয়া বেশ আরাম করিয়া বসিল— কাঠকুড়ানি মেয়ের প্রসঙ্গে ছেলেবেলাকার রূপকথার অলিগলির মধ্যে তাহার মন ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল । এমন সময় আবার পটলের হাসিমাথ কণ্ঠের কাকলিতে সে চমকিয়া উঠিল। পটল আর-একটি মেয়ের হাত ধরিয়া সবেগে টানিয়া আনিয়া যতীনের সম্মুখে স্থাপন করিল ; কহিল, “ও কুড়ানি।” মেয়েটি কহিল, “কণী, দিদি ।” পটল । আমার এই ভাইটি কেমন দেখ দেখি । মেয়েটি অসংকোচে যতীনকে দেখিতে লাগিল। পটল কহিল, “কেমন, ভালে৷ দেখিতে না ?” মেয়েটি গম্ভীরভাবে বিচার করিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “হা, ভালো।” যতীন লাল হইয়। চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া কহিল, "আঃ পটল, কী ছেলেমাতুষি করিতেছ।”