পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२b-8 রবীন্দ্র-রচনাবলী এবং নিজের বাসায় লইয়া গেল। পটলকে সমস্ত খবর দিয়া একখানি চিঠিও লিখিয়া দিল । সেইদিন সন্ধ্যার সময় রোগী এবং চিকিৎসক ছাড়া ঘরে আর কেহ ছিল না। শিয়রের কাছে রঙিন কাগজের আবরণে ঘেরা একটি কেরোসিন ল্যাম্প, ছায়াচ্ছন্ন মৃত্যু আলোক বিকীর্ণ করিতেছিল – ব্র্যাকেটের উপরে একটা ঘড়ি নিস্তব্ধ ঘরে টিক্‌টিকৃ শব্দে দোলক দোলাইতেছিল। যতীন কুড়ানির কপালে হাত দিয়া কহিল, “তুমি কেমন বোধ করিতেছ, কুড়ানি।” কুড়ানি তাহার কোনো উত্তর না করিয়া যতীনের হাতটি আপনার কপালেই চাপিয়া রাখিয়া দিল । যতীন আবার জিজ্ঞাসা করিল, “ভালো বোধ হইতেছে ?” কুড়ানি একটুখানি চোখ বুজিয়া কহিল, “ই ।” যতীন জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার গলায় এটা কী, কুড়ানি।” কুড়ানি তাড়াতাড়ি কাপড়টা টানিয়া তাহ ঢাকিবার চেষ্টা করিল। যতীন দেখিল, সে একগাছি শুকনো বকুলের মালা। তখন তাহার মনে পড়িল, সে মালাটা কী। ঘড়ির টিক্‌টিক শব্দের মধ্যে যতীন চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। কুড়ানির এই প্রথম লুকাইবার চেষ্টা— নিজের হৃদয়ের ভাব গোপন করিবার এই তাহার প্রথম প্রয়াস। কুড়ানি মৃগশিশু ছিল, সে কখন হৃদয়ভারাতুর যুবতী নারী হইয়া উঠিল। কোন রৌদ্রের আলোকে, কোন রৌদ্রের উত্তাপে তাহার বুদ্ধির উপরকার সমস্ত কুয়াশ কাটিয়া গিয়া তাহার লজ্জা, তাহার শঙ্কা, তাহার বেদনা এমন হঠাৎ প্রকাশিত হইয়া পড়িল । রাত্ৰি দুটা-আড়াইটার সময় যতীন চৌকিতে বসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। হঠাৎ দ্বার খোলার শব্দে চমকিয়া উঠিয়া দেখিল, পটল এবং হরকুমারবাবু এক বড়ে ব্যাগ হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন । হরকুমার কহিলেন, “তোমার চিঠি পাইয়। কাল সকালে আসিব বলিয়া বিছানায় শুইলাম। অর্ধেক রাত্রে পটল কহিল, ওগো, কাল সকালে গেলে কুড়ানিকে দেখিতে পাইব ন!— আমাকে এখনই যাইতে হইবে। পটলকে কিছুতেই বুঝাইয়া রাখা গেল না, তখনই একটা গাড়ি করিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছি।” পটল হরকুমারকে কহিল, “চলো, তুমি যতীনের বিছানায় শোবে চলো।” হরকুমার ঈষৎ আপত্তির আড়ম্বর করিয়া যতীনের ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িলেন, তাহার নিদ্রা যাইতেও দেরি হইল না।