পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8७२ · রবীন্দ্র-রচনাবলী অংশ ধীয়মন্দ সকরুণ, শেষ অংশট নাচের তালে। আমাদের দিশি স্কুরের সঙ্গে স্থানে স্থানে অনেক মিল দেখতে পাই । বাংলাদেশের সঙ্গে একটা ঐক্য দেখছি— এখানকার সংগীত কাব্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয়। ইস্ফাহানে যাত্রা করবার পূর্বে বিশ্রাম করে নিচ্ছি। বসে আছি দোতলার মাত্র-পাত লম্বা বারানায়। সম্মুখপ্রান্তে রেলিঙের গায়ে গায়ে টবে সাজানো পুম্পিত জেরেনিয়ম । নীচের বাগানে ফুলের কেয়ারির মাঝখানে ছোটো জলাশয়ে একটি নিক্রিয় ফোয়ারা, আর সেই কেয়ারিকে প্রদক্ষিণ করে কলশব্দে জলস্রোত বয়ে চলেছে। অদূরে বনস্পতির বীথিক। আকাশে পাণ্ডুর নীলিমার গায়ে তরুহীন বলি-জঙ্কিত পাহাড়ের তরঙ্গায়িত ধূসর রেখা। দূরে গাছের তলায় কারা একদল বসে গল্প করছে। ঠাও হাওয়া, নিস্তন্ধ মধ্যাহ্ন। শহর থেকে দূরে অাছি, জনতার সম্পর্ক নেই, পাখিরা কিচিমিচি করে উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের নাম জানি নে । সঙ্গীরা শহরে কে কোথায় চলে গেছে, চিরক্লান্ত দেহ চলতে নারাজ তাই একলা বসে আছি। পারস্তে আছি সে কথা বিশেষ করে মনে করিয়ে দেবার কিছুই নেই। এই আকাশ, বাতাস, কম্পমান সবুজ পাতার উপর কম্পমান এই উজ্জল আলো, আমারই দেশের শীতকালের মতো। শিরাজ শহরটি যে প্রাচীন তা বলা যায় না। আরবেরা পারস্য জয় করার পরে তবে এই শহরের উদ্ভব। সাফাবি-শাসনকালে শিরাজের যে শ্ৰীবৃদ্ধি হয়েছিল আফগান আক্রমণে তা ধ্বংস হয়ে যায়। আগে ছিল শহর ঘিরে পাথরের তোরণ, সেটা ভূমিসাৎ হয়ে তার জায়গায় উঠেছে মাটির দেয়াল। নিষ্ঠুর ইতিহাসের হাত থেকে পারস্ত যেমন বরাবর আঘাত পেয়েছে পৃথিবীতে আর-কোনো দেশ এমন পায় নি, তবু তার জীবনীশক্তি বারবার নিজের পুনঃসংস্কার করেছে। বর্তমান যুগে আবার সেই কাজে সে লেগেছে, জেগে উঠেছে আপন মুছিত দশা থেকে। (? চলেছি ইম্ফাহানের দিকে। বেলা সাতটার পর শিরাজের পুরস্কার দিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। গিরিশ্ৰেণীর মধ্য দিয়ে চলা শুরু হল। পিছনে তাকিয়ে মনে হয় যেন গিরিপ্রকৃতি শিলাঞ্জলিতে শিরাজকে অর্ঘ্যরূপে ঢেলে দিয়েছে। শিরাজের বাইরে লোকালয় একেবারে অম্ভহিত, তার পরিশিষ্ট কিছুই নেই, গাছপালাও দেখা যায় মা। বৈচিত্র্যহীন রিক্ততার মধ্য দিয়ে যে পথ চলেছে একেবেঁকে সেটা মোটর-রথের পক্ষে প্রশস্ত ও অপেক্ষাকৃত অবন্ধুর।