পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পারস্ত্যে 8b"Q Եր আজ ৫ই মে তেহেরানের জনসভায় আমার প্রথম বক্তৃত । সভা ভঙ্গ হলে আমাদের নিয়ে গেল এখানকার একজন সংগীতগুণীর বাড়িতে । ছোটো একটি গলির ধারে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলুম। শানবাধানে চৌকো উঠোন, তারই মধ্যে একটুখানি জলাশয়, গোলাপ ধরেছে গাছে, ছোটো ছোটো টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম সামনে দালান, সেখানে বাজিয়ের দল অপেক্ষা করছে। বাজনার মধ্যে একটি তারযন্ত্র, একটি বাশি, বাকি অনেকগুলি বেহালা । আমরা সেখানে আসন নিলে পর প্রধান গুণী বললেন, আমি জানি আপনি ইচ্ছা করেন দেশপ্রচলিত কলাবিদ্যার স্বরূপ নষ্ট না হয়। আমরাও তাই চাই। সংগীতের স্বদেশী স্বকীয়তা রক্ষা করে আমরা তার সঙ্গে যুরোপীয় স্বরসংগতিতত্ত্ব যোগ করতে চেষ্টা করি। আমি বললুম, ইতিহাসে দেখা যায় পারসিকদের গ্রহণ করবার প্রবলশক্তি আছে। এশিয়ার প্রায় সকল দেশেই আজ পাশ্চাত্য ভাবের সঙ্গে প্রাচ্য ভাবের মিশ্রণ চলছে। এই মিশ্রণে নূতন স্বষ্টির সম্ভাবনা। এই মিলনের প্রথম অবস্থায় দুই ধারার রঙের তফাতটা থেকে যায়, অনুকরণের জোরটা মরে না। কিন্তু আন্তরিক মিলন ক্রমে ঘটে, যদি সে মিলনে প্রাণশক্তি থাকে ; কলমের গাছের মতো নৃতনে পুরাতনে ভেদ লুপ্ত হয়ে ফলের মধ্যে রসের বিশিষ্টতা জন্মে। আমাদের আধুনিক সাহিত্যে এটা ঘটেছে, সংগীতেও কেন ঘটবে না বুঝি নে। যে চিত্তের মধ্যে দিয়ে এই মিলন সম্ভবপর হয় আমরা সেই চিত্তের অপেক্ষা করছি, য়ুরোপীয় সাহিত্যচর্চা প্রাচ্য শিক্ষিতসমাজে যে পরিমাণে অনেক দিন ধরে অনেকের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়েছে য়ুরোপীয় সংগীতচর্চাও যদি তেমনি হত তা হলে নিঃসন্দেহই প্রাচ্য সংগীতে রসপ্রকাশের একটি নূতন শক্তিসঞ্চার হত। যুরোপের আধুনিক চিত্রকলায় প্রাচ্য চিত্রকলার প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছে এ তো দেখা গেছে ; এতে তার আত্মতা পরাভূত হয় না, বিচিত্ৰতর— প্রবলতর হয়। . ነ তার পরে তিনি একলা একটি স্বর তার তারযন্ত্রে বাজালেন। সেটি বিশুদ্ধ ভৈরবী, উপস্থিত সকলেরই সেটি অস্তরের মধ্যে প্রবেশ করল। ইনি বললেন, জানি, এরকম স্থর আমাদেরকে একভাবে মুগ্ধ করে, কিন্তু অন্তরকম জিনিসটারও বিশেষ মূল্য আছে। পরম্পরের মধ্যে ঈর্ষ জন্মিয়ে দিয়ে একটার খাতিরে অন্তকে বর্জন করা নিজের লোকসান করা । কী জানি, লোকটির যদি শক্তি থাকে তবে পারসিক সংগীতে ইনি যে নূতন’ বাণিজ্যের প্রবর্তন করছেন ক্রমে হয়তো কলারাজ্যে তা লাভের সামগ্রী হয়ে দাড়াবে।