পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

*, ৪২৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী “আমাদের এই ঘর। আমরা ঘর ছাড়িয়া পালাইয়াছিলাম। মোগল সৈন্ত চলিয়া গিয়াছে শুনিয়া তবে এখানে আসিয়াছি।” রঘুপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, “মোগল সৈন্ত কোন দিকে গিয়াছে।” তাহারা কহিল, "বিজয়গড়ের দিকে । এত ক্ষণ বিজয়গড়ের বনের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।” 缸 রঘুপতি আর অধিক কিছু না বলিয়। তৎক্ষণাং মাত্রা করিলেন । বিংশ পরিচ্ছেদ বিজয়গড়ের দীর্ঘ বন ঠগীদের অড়ি । বনের মধ্য দিয়া যে পথ গিয়াছে সেই পথের দুই পাশ্বে কত মনুষ্য-কঙ্কাল নিহিত আছে, তাহাদের উপরে কেবল বনফুল ফুটিতেছে, আর কোনো চিহ্ন নাই। বনের মধ্যে বট আছে, বাবলা আছে, নিম আছে, শত শত প্রকারের লতা ও গুল্ম আছে। স্থানে স্থানে ডোবা অথবা পুকুরের মতো দেখা যায়। অবিশ্রাম পাতা পচিয়া পচিয়া তাহার জল একেবারে সবুজ হইয়া উঠিয়াছে । ছোটো ছোটে। মুড়ি পথ এদিকে ওদিকে আঁকিয়া বাকিয়া সাপের মতো অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে । গাছের ডালে ডালে, পালে পালে হকুমান । বটগাছের ডালের উপর হইতে শত শত শিকড় এবং হনুমানের লেজ ঝুলিতেছে । ভাঙা মন্দিরের প্রাঙ্গণে শিউলি ফুলের গাছ সাদা সাদা ফুলে এবং হকুমানের দস্তবিকাশে একেবারে আচ্ছন্ন। সন্ধ্যাবেলায় বড়ো বড়ো ঝাকড়া গাছের উপরে ঝণকে বাকে টিয়াপাখির চীংকারে বনের ঘোর অন্ধকার যেন দীর্ণ বিদীর্ণ হইতে থাকে । আজ এই বৃহৎ বনের মধ্যে প্রায় কুড়ি হাজার সৈন্ত প্রবেশ করিয়াছে । এই ডালেপালায় লতায়-পাতায় তৃণে-গুন্মে জড়িত বৃহৎ গোলাকার অরণ্য, কুড়ি হাজার ধরনথচষ্ণু সৈনিক বাজপক্ষীদের একটিমাত্র নীড় বলিয়া বোধ হইতেছে । সৈন্তসমাগম দেখিয়া অসংখ্য কাক কা কা করিয়া দল বাধিয়া আকাশে উড়িয়া ৰেড়াইতেছে—সাহল করিয়া ডালের উপর আসিয়া বসিতেছে না । কোনো প্রকার গোলমাল করিতে সেনাপতির নিষেধ আছে । সৈন্তেরা সমস্ত দিন চলিয়া সন্ধ্যাবেলায় বনে আসিয়া শুক কাঠ কুড়াইয়া রন্ধন করিতেছে ও পরম্পর চুপি চুপি কথা কহিতেছে—তাহাজের সেই গুন গুন শৰে সমস্ত অরণ্য গমগম করিতেছে, সন্ধ্যাবেলায় ঝিকি পোকার ডাক শোনা যাইতেছে না। গাছের গুড়িতে বাধা অশ্বের মাঝে মাঝে খুর দিয়া মাটি খুড়িতেছে