পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি \S)Id S বেহারি- তোরা সব সুখে থাক, আমার জন্যে কিছুই আটকাইবে না।” বিহারী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তার পরে কহিল, “মহেন্দ্রের ভাগ্য মন্দ, তোমাকে সে অন্নপূর্ণ চকিত হইয়া কহিলেন, “আমন কথা বলিস নে। আমি মহিনের উপর কিছুই রাগ করি নাই । আমি না গেলে সংসারের মঙ্গল হইবে না।” বিহারী দূরের দিকে চাহিয়া নীরবে বসিয়া রহিল। অন্নপূর্ণ অঞ্চল হইতে এক জোড়া মোটা সোনার বালা খুলিয়া কহিলেন, “বাবা, এই বালাজোড়া তুমি রাখো— বউমা যখন আসিবেন, আমার বিহারী বালাজোড়া মাথায় ঠেকাইয়া অশ্রু সংবরণ করিতে পাশের ঘরে চলিয়া গেল। বিদায়কালে অন্নপূর্ণ কহিলেন, “ বেহারি, আমার মহিনকে আর আমার আশাকে দেখিস । রাজলক্ষ্মীর হস্তে একখানি কাগজ দিয়া বলিলেন, “শ্বশুরের সম্পত্তিতে আমার যে অংশ আছে, তাহা এই দানপত্ৰে মহেন্দ্ৰকে লিখিয়া দিলাম। আমাকে কেবল মাসে মাসে পনেরোটি করিয়া টাকা পাঠাইয়া *ן }3) fw বলিয়া ভূতলে পড়িয়া রাজলক্ষ্মীর পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইলেন এবং বিদায় হইয়া তীর্থোদেশে যাত্ৰা করিলেন । br আশা কেমন ভয় পাইয়া গেল। এ কী হইল। মা চলিয়া যান, মাসিমা চলিয়া যান। তাহাদের সুখ যেন সকলকেই তাড়াইতেছে, এবার যেন তাহাকেই তাড়াইবার পালা। পরিত্যক্ত শূন্য গৃহস্থলির মাঝখানে দাম্পত্যের নূতন প্রেমলীলা তাহার কাছে কেমন অসংগত ঠেকিতে লাগিল । সংসারের কঠিন কর্তব্য হইতে প্রেমকে ফুলের মতো ছিড়িয়া স্বতন্ত্র করিয়া লইলে, তাহা কেবল আপনার রসে আপনাকে সজীব রাখিতে পারে না, তাহা ক্রমেই বিমর্ষ ও বিকৃত হইয়া আসে। আশাও মনে মনে দেখিতে লাগিল, তাহাদের অবিশ্রাম মিলনের মধ্যে একটা শ্রান্তি ও দুর্বলতা আছে। সে মিলন যেন থাকিয়া থাকিয়া কেবলই মুষড়িয়া পড়ে— সংসারের দৃঢ় ও প্রশস্ত আশ্রয়ের অভাবে তাহাকে টানিয়া খাড়া রাখাই কঠিন হয়। কাজের মধ্যেই প্রেমের মূল না থাকিলে, ভোগের বিকাশ পরিপূর্ণ এবং স্থায়ী হয় না। মহেন্দ্ৰও আপনার বিমুখ সংসারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া আপন প্রেমোৎসবের সকল বাতিগুলাই একসঙ্গে জ্বালাইয়া খুব সমারোহের সহিত শূন্যগৃহের অকল্যাণের মধ্যে মিলনের আনন্দ সমাধা করিতে চেষ্টা করিল। আশার মনে সে একটুখানি খোচা দিয়াই কহিল, “চুনি, তোমার আজকাল কী হইয়াছে বলো দেখি। মাসি গেছেন, তা লইয়া অমন মন ভার করিয়া আছ কেন। আমাদের দুজনার ভালোবাসাতেই কি সকল ভালোবাসার অবসান নয়।” আশা দুঃখিত হইয়া ভাবিত, তবে তো আমার ভালোবাসায় একটা কী অসম্পূর্ণতা আছে। আমি তো মাসির কথা প্রায়ই ভাবি ; শাশুড়ি চলিয়া গেছেন বলিয়া তো আমার ভয় হয়।” তখন সে প্ৰাণপণে এই—সকল প্রেমের অপরাধ ক্ষালন করিতে চেষ্টা করে। এখন গৃহকর্ম ভালো করিয়া চলে না— চাকরবাকরেরা ফাকি দিতে আরম্ভ করিয়াছে। একদিন ঝি অসুখ করিয়াছে বলিয়া আসিল না, বামুনঠাকুর মদ খাইয়া নিরুদ্দেশ হইয়া রহিল। মহেন্দ্ৰ আশাকে মহেন্দ্ৰ গাড়ি করিয়া নিউ মার্কেটে বাজার করিতে গেল। কোন জিনিসটা কী পরিমাণে দরকার,