পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৯৮ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আশা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, ভয় কিসের ।” মহেন্দ্ৰ। তোমার সখীর যেরকম রূপের বর্ণনা কর, সে তো বড়ো নিরাপদ জায়গা নয়। আশা কহিল, “আচ্ছা, সে আমি সামলাইতে পারিব। তুমি ঠাট্টা রাখিয়া দাও— তার সঙ্গে আলাপ করিবে কি না বলো ।” বিনোদিনীকে দেখিবে বলিয়া মহেন্দ্রের যে কৌতুহল ছিল না, তাহা নহে। এমন-কি, আজকাল তাহাকে দেখিবার জন্য মাঝে মাঝে আগ্রহও জন্মে। সেই অনাবশ্যক আগ্রহটিা তাহার নিজের কাছে উচিত বলিয়া ঠেকে নাই। হৃদয়ের সম্পর্ক সম্বন্ধে মহেন্দ্রের উচিত-অনুচিতের আদর্শ সাধারণের অপেক্ষা কিছু কড়া। পাছে মাতার অধিকার লেশমাত্র ক্ষুন্ন হয়, এইজন্য ইতিপূর্বে সে বিবাহের প্রসঙ্গমাত্র কানে আনিত না। আজকাল, আশার সহিত সম্বন্ধকে সে এমনভাবে রক্ষা করিতে চায় যে, অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি সামান্য কৌতুহলকেও সে মনে স্থান দিতে চায় না। প্রেমের বিষয়ে সে যে বড়ো খুঁতখুঁতে এবং অত্যন্ত খাটি, এই লইয়া তাহার মনে একটা গর্ব ছিল। এমন-কি, বিহারীকে সে বন্ধু বলিত বলিয়া অন্য কাহাকেও বন্ধু বলিয়া স্বীকার করিতেই চাহিত না। অন্য কেহ যদি তাহার নিকট আকৃষ্ট হইয়া আসিত, তবে মহেন্দ্ৰ যেন তাহাকে গায়ে পডিয়া উপেক্ষা দেখাইত, এবং বিহারীর নিকটে সেই হতভাগ্য সম্বন্ধে উপহাসতীব্র অবজ্ঞা প্ৰকাশ করিয়া ইতরসাধারণের প্রতি নিজের একান্ত ঔদাসীন্য ঘোষণা করিত। বিহারী ইহাতে আপত্তি করিলে মহেন্দ্ৰ বলিত, “তুমি পার বিহারী, যেখানে যাও তোমার বন্ধুর অভাব হয় না ; আমি কিন্তু যাকে-তাকে বন্ধু বলিয়া টানাটানি করিতে পারি না।” সেই মহেন্দ্রের মন আজকাল যখন মাঝে মাঝে অনিবার্য ব্যগ্রতা ও কৌতুহলের সহিত এই অপরিচিতার প্রতি আপনি ধাবিত হইতে থাকিত তখন সে নিজের আদর্শের কাছে যেন খাটাে হইয়া পড়িত। অবশেষে বিরক্ত হইয়া বিনোদিনীকে বাটী হইতে বিদায় করিয়া দিবার জন্য সে তাহার মাকে পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করিল। মহেন্দ্ৰ কহিল, “থাক চুনি। তোমার চোখের বালির সঙ্গে আলাপ করিবার সময় কই। পড়িবার সময় ডাক্তারি বই পড়িব, অবকাশের সময় তুমি আছ, ইহার মধ্যে সখীকে কোথায় আনিবে।” আশা কহিল, “আচ্ছা, তোমার ডাক্তারিতে ভাগ বসাইব না, আমারই অংশ আমি বালিকে দিব ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তুমি তো দিবে, আমি দিতে দিব কেন।” আশা যে বিনোদিনীকে ভালোবাসিতে পারে, মহেন্দ্ৰ বলে, ইহাতে তাহার স্বামীর প্রতি প্রেমের খৰ্ব্বতা প্ৰতিপন্ন হয় | মহেন্দ্ৰ অহংকার করিয়া বলিত, “আমার মতো অনন্যনিষ্ঠ প্ৰেম তোমার নাহে।” আশা তাহা কিছুতেই মানিত না— ইহা লইয়া ঝগড়া করিত, কঁাদিত, কিন্তু তর্কে জিতিতে পারিত না । মহেন্দ্ৰ তাহাদের দুজনের মাঝখানে বিনোদিনীকে সূচ্যগ্ৰ স্থান ছাড়িয়া দিতে চায় না, ইহাই তাহার গর্বের বিষয় হইয়া উঠিল। মহেন্দ্রের এই গর্ব আশার সহ্য হইত না, কিন্তু আজ সে পরাভব স্বীকার করিয়া কহিল, “আচ্ছা, বেশ, আমার খাতিরেই তুমি আমার বালির সঙ্গে আলাপ করো।” আশার নিকট মহেন্দ্র নিজের ভালোবাসার দৃঢ়তা ও শ্রেষ্ঠতা প্ৰমাণ করিয়া অবশেষে বিনোদিনীর সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য অনুগ্রহপূর্বক রাজি হইল। বলিয়া রাখিল, “কিন্তু তাই বলিয়া যখন-তখন উৎপাত করিলে বাচিব না।” কী আশ্চর্য। চকোরী যে আজ চাদকে ছাডিয়া মেঘের দরবারে!” আশা কহিল, “তোমাদের ও-সব কবিতার কথা আমার আসে না ভাই, কেন বেনাবনে মুক্তা ছড়ানো। যে তোমার কথার জবাব দিতে পরিবে, একবার তাহার কাছে কথা শোনাও'সে।” বিনোদিনী কহিল, “ সে রসিক লোকটি কে।” আশা কহিল, “তোমার দেবর, আমার স্বামী। না ভাই, ঠাট্টা নয়- তিনি তোমার সঙ্গে আলাপ