পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& S S রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়াই যে তাহা গড়িয়া উঠিয়াছিল এবং কেমন করিয়াই যে তাহা নষ্ট হইতেছে, এবং কেমন করিলে যে তাহার প্রতিকার হইতে পারে তাহা সে জানে না। থাকিয়া থাকিয়া কেবল গলা ছাডিয়া কাদিয়া বলিতে ইচ্ছা করে, “আমি অত্যন্ত অযোগ্য, নিতান্ত অক্ষম, আমার মৃঢ়তার কোথাও তুলনা নাই।” পূর্বে তো আশা ও মহেন্দ্ৰ সুদীর্ঘকাল দুই জনে এক গৃহকোণে বসিয়া কখনো কথা কহিয়া, কখনো কথা না কহিয়া, পরিপূর্ণ সুখে সময় কাটাইয়াছে। আজকাল বিনোদিনীর অভাবে আশার সঙ্গে একলা বসিয়া মহেন্দ্রের মুখে কিছুতেই যেন সহজে কথা জোগায় না— এবং কিছু না কহিয়া চুপ করিয়া থাকিতেও তাহার বাধো-বাধো ঠেকে। “বহু-ঠাকুরানী।” ( বিনোদিনী ) “ দেখি” বলিয়া চিঠিখানা লইল। ইচ্ছা হইল ছিড়িয়া পড়ে। দু-চারিবার উলটাপালটা করিয়া নাড়িয়া-চাড়িয়া বেহারিার হাতে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল। যদি চিঠি খুলিত, তবে দেখিত, তাহাতে লেখা আছে, “পিসিমা কোনোমতেই সাগু-বালি খাইতে চান না, আজ কি তাহাকে ডালের ঝোল খাইতে দেওয়া হইবে।” ঔষধপথ্য লইয়া বিনোদিনী মহেন্দ্ৰকে কখনো কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিত না, সে-সম্বন্ধে বিহারীর প্রতিই তাহার নির্ভর । মহেন্দ্ৰ বারান্দায় খানিকক্ষণ পায়চারি করিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দড়ি ছিন্নপ্ৰায় হওয়াতে ছবিটা বাকা হইয়া আছে। আশাকে অত্যন্ত ধমক দিয়া কহিল, “ তোমার চোখে কিছুই পড়ে না, এমনি করিয়া সমস্ত জিনিস নষ্ট হইয়া যায়।” দমদমের বাগান হইতে ফুল সংগ্ৰহ করিয়া যে-তোড়া বিনোদিনী পিতলের ফুলদানিতে সাজাইয়া রাখিয়াছিল, আজও তাহা শুষ্ক অবস্থায় তেমনিভাবে আছে ; অন্যদিন মহেন্দ্র এ-সমস্ত লক্ষই করে না— আজ তাহা চোখে পড়িল। কহিল, “বিনোদিনী আসিয়া না ফেলিয়া দিলে, ও আর ফেলাই হইবে না।” বলিয়া ফুলসুদ্ধ ফুলদানি বাহিরে ষ্টুড়িয়া ফেলিল, তাহা ঠংঠং শব্দে সিঁড়ি দিয়া গড়াইয়া চলিল। কেন আশা আমার মনের মতো হইতেছে না, কেন সে আমার মনের মতো কাজ করিতেছে না, কেন তাহার স্বভাবগত শৈথিল্যে ও দুর্বলতায় সে আমাকে দাম্পত্যের পথে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া রাখিতেছে না, সর্বদা আমাকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিতেছে।”— এই কথা মহেন্দ্ৰ মনে মনে আন্দোলন করিতে করিতে হঠাৎ দেখিল, আশার মুখ পাংশুবৰ্ণ হইয়া গেছে, সে খাটের থাম ধরিয়া আছে, তাহার ঠোট-দুটি কঁাপিতেছে— কাপিতে কঁাপিতে সে হঠাৎ বেগে পাশের ঘর দিয়া চলিয়া গেল । মহেন্দ্র তখন ধীরে ধীরে গিয়া ফুলদানিটা কুড়াইয়া আনিয়া রাখিল । ঘরের কোণে তাহার পড়িবার টেবিল ছিল- চৌকিতে বসিয়া সেই টেবিলটার উপর হাতের মধ্যে মাথা রাখিয়া অনেকক্ষণ পডিয়া রহিল। সন্ধ্যার পর ঘরে আলো দিয়া গেল, কিন্তু আশা আসিল না। মহেন্দ্র দ্রুতপদে ছাদের উপর পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। রাত্ৰি নটা বাজিল, মহেন্দ্ৰদের লোকবিরল গৃহ রাত-দুপুরের মতো নিস্তব্ধ হইয়া গেল।-- তবু আশা আসিল না। মহেন্দ্ৰ তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইল। আশা সংকুচিত পদে আসিয়া ছাদের প্রবেশদ্বারের কাছে দাড়াইয়া রহিল। মহেন্দ্র কাছে আসিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইল- মুহুর্তের মধ্যে স্বামীর বুকের উপর আশার কান্না ফাটিয়া পড়িল— সে আর থামিতে পারে না, তাহার চোখের জল আর ফুরায় না, কান্নার শব্দ গলা ছাড়িয়া বাহির হইতে চায়, সে আর চাপা থাকে না। মহেন্দ্ৰ তাহাকে বক্ষে বদ্ধ করিয়া কেশচুম্বন করিল— নিঃশব্দ আকাশে তারাগুলি নিস্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। রাত্রে বিছানায় বসিয়া মহেন্দ্ৰ কহিল, “কলেজে আমাদের নাইট-ডিউটি অধিক পড়িয়াছে, অতএব এখন কিছুকাল আমাকে কলেজের কাছেই বাসা করিয়া থাকিতে হইবে।”