পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 (? বিনোদিনীর ভাবখানা দেখিয়া হঠাৎ তাহার বিশ্বসংসার অন্ধকার হইয়া উঠিল। সে বিনোদিনীকে স্পষ্ট করিয়া কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিল না। দেয়ালের কাছে একটা সোফার উপরে বসিল । বিনোদিনীও তাহার পাশে বসিয়া দৃঢ় বাহু দিয়া আশাকে বুকের কাছে বাধিয়া ধরিল। সখীর সেই আলিঙ্গনে আশা আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, তাহার দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। দ্বারের কাছে অন্ধ ভিখারি খঞ্জনি বাজাইয়া গাহিতেছিল, ‘চরণতরণী দে মা, তারিণী তারা।” বিহারী মহেন্দ্রের সন্ধানে আসিয়া দ্বারের কাছে পৌছিতেই দেখিল— আশা কঁদিতেছে, এবং বিনোদিনী তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে তাহার চােখ মুছইয়া দিতেছে। দেখিয়াই বিহারী সেখান হইতে সরিয়া দাড়াইল। পাশের শূন্য ঘরে গিয়া অন্ধকারে বসিল! দুই করতলে মাথা চাপিয়া ধরিয়া ভাবিতে লাগিল, আশা কেন কঁদিবে। যে মেয়ে স্বভাবতই কাহারও কাছে লেশমাত্র অপরাধ করিতে অক্ষম, তাহাকেও কাদাইতে পারে এমন পাষণ্ড জগতে কে আছে! তার পরে বিনোদিনী যেমন করিয়া সাস্তুনা করিতেছিল, তাহা মনে আনিয়া মনে মনে কহিল, “বিনােদিনীকে ভারি ভুল । সেবায় সাস্তুনায়, নিঃস্বার্থ সখীপ্ৰেমে সে মর্তবাসিনী দেবী।” বিহারী অনেকক্ষণ অন্ধকারে বসিয়া রহিল। অন্ধের গান থামিয়া গেলে বিহারী সশব্দে পা ফেলিয়া, কাশিয়া, মহেন্দ্রের ঘরের দিকে চলিল। দ্বারের কাছে না। যাইতেই ঘোমটা টানিয়া আশা দ্রুতপদে অন্তঃপুরের দিকে ছুটিয়া গেল। ঘরে ঢুকিতেই বিনোদিনী বলিয়া উঠিল, “এ কী বিহারীবাবু! আপনার কি অসুখ করিয়াছে।” বিহারী। কিছু না। বিনোদিনী। চোখ দুটো আমন লাল কেন। বিহারী তাহার উত্তর না দিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, মহেন্দ্ৰ কোথায় গেল।” বিনোদিনী মুখ গভীর করিয়া কহিল, “শুনিলাম, হাসপাতালে তাহার কাজ পড়িয়াছে বলিয়া কলেজের কাছে তিনি বাসা করিয়া আছেন। বিহারীবাবু একটু সরুন, আমি তবে আসি।” অন্যমনস্ক বিহারী দ্বারের কাছে বিনোদিনীর পথরোধ করিয়া দাড়াইয়াছিল। চকিত হইয়া তাড়াতাড়ি পথ ছাড়িয়া দিল। সন্ধ্যার সময় একলা বাহিরের ঘরে বিনোদিনীর সঙ্গে কথাবার্তা লোকের চক্ষে সুদৃশ্য নয়, সে কথা হঠাৎ মনে পড়িল। বিনোদিনীর চলিয়া যাইবার সময় বিহারী তাড়াতাড়ি বলিয়া লইল, “বিনোদ-বোঠান, আশাকে তুমি দেখিয়ো। সে সরলা, কাহাকেও আঘাত করিতেও জানে না, নিজেকে আঘাত হইতে বাচাইতেও পারে না।” বিহারী অন্ধকারে বিনোদিনীর মুখ দেখিতে পাইল না, সে মুখে হিংসার বিদ্যুৎ খেলিতে লাগিল। আজ বিহারীকে দেখিয়াই সে বুঝিয়েছিল যে, আশার জন্য করুণায় তাহার হৃদয় ব্যথিত। বিনোদিনী নিজে কেহই নহে! আশাকে ঢাকিয়া রাখিবার জন্য, আশার পথের কাটা তুলিয়া দিবার জন্য, আশার সমস্ত সুখ সম্পূৰ্ণ করিবার জন্যই তাহার জন্ম! শ্ৰীযুক্ত মহেন্দ্ৰবাবু আশাকে বিবাহ করিবেন, সেইজন্য বিহারীবাবু সরলা আশার চোখের জল দেখিতে পারেন না, সেইজন্য বিনোদিনীকে তাহার আঁচলের প্রান্ত তুলিয়া সর্বদা প্ৰস্তুত হইয়া থাকিতে হইবে। একবার এই মহেন্দ্ৰকে, এই বিহারীকে, বিনোদিনী তাহার পশ্চাতের ছায়ার সহিত ধুলায় লুষ্ঠিত করিয়া বুঝাইতে চায়, আশাই বা কে আর বিনোদিনীই বা কে! দুজনের মধ্যে কত প্ৰভেদ ! প্রতিকূল ভাগ্য-বশত বিনোদিনী আপন প্রতিভাকে কোনো পুরুষের চিত্তক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে জয়ী করিতে না পারিয়া জ্বলন্ত শক্তিশেল উদ্যত করিয়া সংহারমূর্তি ধরিল। অত্যন্ত মিষ্টস্বরে বিনোদিনী বিহারীকে বলিয়া গেল, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন, বিহারীবাবু। আমার চোখের বালির জন্য ভাবিয়া ভাবিয়া নিজেকে বেশি কষ্ট দিবেন না।”