পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SRO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আশা কহিল, “কখনো না।” তখন মহেন্দ্র তাহাকে টানিয়া লইয়া চুম্বন করল। আশা কহিল, "চিঠিগুলা দাও, ছিড়িয়া "ן মহেন্দ্ৰ কহিল, “না, ও থাক ।” আশা সবিনয়ে মনে করিল, “আমার শাস্তিস্বরূপ এ চিঠিগুলি উনি রাখিলেন।” এই চিঠির ব্যাপারে বিনোদিনীর উপর আশার মনটা একটু যেন বাকিয়া দাড়াইল। স্বামীর আগমনবার্তা লইয়া সে সখীর কাছে আনন্দ করিতে গেল না— বরঞ্চ বিনােদিনীকে একটু যেন এড়াইয়া গেল। বিনােদিনী সেটুকু লক্ষ করিল এবং কাজের ছল করিয়া একেবারে দূরে রহিল। মহেন্দ্ৰ ভাবিল, “এ তো বড়ো অদ্ভুত। আমি ভাবিয়ছিলাম, এবার বিনোদিনীকে বিশেষ করিয়াই দেখা যাইবে— উলটা হইল ? তবে সে চিঠিগুলার অর্থ কী।” করিয়াছিল- ভাবিয়ছিল, “বিনোদিনী যদি কাছে আসিবার চেষ্টা করে, তবু আমি দূরে থাকিব।' আজি সে মনে মনে কহিল, “না, এ তো ঠিক হইতেছে না। যেন আমাদের মধ্যে সত্যই কী একটা বিকার ঘটিয়াছে। বিনোদিনীর সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা আমোদপ্রমোদ করিয়া এই সংশয়াচ্ছন্ন গুমটের ভাবটা দূর করিয়া দেওয়া উচিত।” আশাকে মহেন্দ্ৰ কহিল, “ দেখিতেছি, আমিই তোমার সখীর চোখের বালি হইলাম। আজকাল তাহার। আর দেখাই পাওয়া যায় না।” আশা উদাসীন ভাবে উত্তর করিল, “ কে জানে, তাহার কী হইয়াছে।” এ দিকে রাজলক্ষ্মী আসিয়া কাদো-কাদো হইয়া কহিলেন, “বিপিনের বউকে আর তো ধরিয়া রাখা যায় না ।” মহেন্দ্ৰ চকিত ভাব সামলাইয়া কহিল, “কেন, মা ।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কী জানি বাছা, সে তো এবার বাড়ি যাইবার জন্য নিতান্তই ধরিয়া পড়িয়াছে। তুই তো কাহাকেও খাতির করিতে জনিস না। ভদ্রলোকের মেয়ে পরের বাড়িতে আছে, উহাকে আপনার লোকের মতো আদর-যত্বে না করিলে থাকিবে কেন।” বিনোদিনী শোবার ঘরে বসিয়া বিছানার চাদর সেলাই করিতেছিল। মহেন্দ্ৰ প্ৰবেশ করিয়া বিনোদিনী সংযত হইয়া বসিল। কহিল, “কী, মহেন্দ্ৰবাবু।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “কী সর্বনাশ। মহেন্দ্র আবার বাবু হইলেন কবে।” ডাকিব ।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “তোমার সখীকে যা বল— চোখের বালি।” বিনাদিনী অনাদিনের মতাে ঠাটা করিয়া তাহার কােনাে উত্তর দিল না— সেলাই করিয়া যাইতে व्लोव्न । মহেন্দ্ৰ কহিল, “ওটা বুঝি সত্যকার সম্বন্ধ হইল, তাই ওটা আর পাতানো চলিতেছে না!” বিনোদিনী একটু থামিয়া দাঁত দিয়া সেলাইয়ের প্রান্ত হইতে খানিকটা বাড়তি সূতা কাটিয়া ফেলিয়া কহিল, “কী জানি, সে আপনি জানেন।” বলিয়াই তাহার সর্বপ্রকার উত্তর চাপা দিয়া গভীরমুখে কহিল, “কালেজ হইতে হঠাৎ ফেরা হইল যে ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “ কেবল মড়া কাটিয়া আর কত দিন চলিবে ।” আবার বিনোদিনী দন্ত দিয়া সুতা ছেদন করিল এবং মুখ না তুলিয়াই কহিল, “এখন বুঝি জিয়ন্তের আবশ্যক।”