পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 S লাগিল, ‘ব্যাপারখানা কী । মহেন্দ্র যখন কাশী গেল আশা এখানে রহিল ; আবার মহেন্দ্র যখন ফিরিল তখন আশা কাশী যাইতে চাহিতেছে। দুজনের মাঝখানে একটা কী গুরুতর ব্যাপার ঘটিয়াছে। এমন করিয়া কতদিন চলিবে ? বন্ধু হইয়াও আমরা ইহার কোনো প্ৰতিকার করিতে পারিব না— দূরে দড়িাইয়া থাকিব ?” ইতিমধ্যে মহেন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নাই- তাই আশা তাহাকে পাশের ঘর হইতে মহেন্দ্রের কাছে লইয়া আসিবার জন্য অনুরোধ করিতেছিল। এমন সময় বিহারী আসিয়া মহেন্দ্ৰকে জিজ্ঞাসা করিল, “আশা-বোঠানের কি কাশী যাওয়া স্থির হইয়াছে।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “না হইবে কেন । বাধাটা কী আছে ?” বিহারী কহিল, “বাধার কথা কে বলিতেছে। কিন্তু হঠাৎ এ খেয়াল তোমাদের মাথায় আসিল যে ?” মহেন্দ্ৰ কহিল, “মাসিকে দেখিবার ইচ্ছা— প্রবাসী আত্মীয়ের জন্য ব্যাকুলতা, মানবচরিত্রে এমন মাঝে মাঝে ঘটিয়া থাকে ৷” বিহাবী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি সঙ্গে যাইতেছ?” প্রশ্ন শুনিয়াই মহেন্দ্ৰ ভাবিল, “জেঠার সঙ্গে আশাকে পাঠানো সংগত নহে, এই কথা লইয়া আলোচনা করিতে বিহারী আসিয়াছে।’ পাছে অধিক কথা বলিতে গেলে ক্ৰোধ উচ্ছসিত হইয়া উঠে, তাই সংক্ষেপে বলিল, “না।” বিহারী মহেন্দ্ৰকে চিনিত । সে যে রাগিয়াছে, তাহা বিহারীর আগোচর ছিল না। একবার জিদ ধরিলে তাহাকে টলানো যায় না, তাহাও সে জানিত। তাই মহেন্দ্রের যাওয়ার কথা আর তুলিল না। মনে মনে ভাবিল, ‘বেচারা আশা যদি কোনো বেদনা বহন করিয়াই চলিয়া যাইতেছে হয়, তবে সঙ্গে বিনোদিনী (গলে তাহার সান্তনা হইবে।” তাই ধীরে ধীরে কহিল, “বিনোদ-বোঠান তার সঙ্গে গেলে হয় ?' মহেন্দ্ৰ গর্জন করিয়া বলিয়া উঠিল, “বিহারী, তোমার মনের ভিতর যে-কথাটা আছে, তাহা স্পষ্ট করিয়া বালা ; আমার সঙ্গে অসরলতা করিবার কোনো দরকার দেখি না। আমি জানি, তুমি মনে মনে সন্দেহ করিয়াছ, আমি বিনোদিনীকে ভালোবাসি । মিথ্যা কথা। আমি বাসি না। আমাকে রক্ষা করিবার জন্য তোমাকে পাহারা দিয়া বেড়াইতে হইবে না। তুমি এখন নিজেকে রক্ষা করে। যদি সরল বন্ধুত্ব তোমার মনে থাকিত, তবে বহুদিন আগে তুমি আমার কাছে তোমার মনের কথা বলিতে এবং নিজেকে বন্ধুর অন্তঃপুর হইতে বহু দূরে লইয়া যাইতে । আমি তোমার মুখের সামনে স্পষ্ট করিয়া বলিতেছি, তুমি আশাকে ভালোবাসিয়ােছ।” অত্যন্ত বেদনার স্থানে দুই পা দিয়া মাড়াইয়া দিলে, আহত ব্যক্তি মুহূর্তকাল বিচার না কবিয়া আঘাতকারীকে যেমন সবলে ধাক্কা দিয়া ফেলিতে চেষ্টা করে- রুদ্ধকণ্ঠ বিহারী তেমনি পাংশুমুখে তাহার চৌকি তইতে উঠিয়া মহেন্দ্রের দিকে ধাবিত হইল-- হঠাৎ থামিয়া বহুকষ্টে স্বর বাহির করিয়া কহিল, “ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করুন, আমি বিদায় হই ।” বলিয়া টলিতে টলিতে ঘার হইতে বাহির হইয়া গেল । পাশের ঘর হইতে বিনোদিনী ছুটিয়া আসিয়া ডাকিল, “বিহারী-ঠাকুরপো!” বিহারী দেয়ালে ভর করিয়া একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিযা কহিল, “কী, বিনোদ-বোঠান!” বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, চোখের বালির সঙ্গে আমিও কাশীতে যাইব ।” বিহারী কহিল, “না না, বোঠান, সে হইবে না, সে কিছুতেই হইবে না ! তোমাকে মিনতি করিতেছি—— আমার কথায় কিছুই করিয়ো না। আমি এখানকার কেহ নাই, আমি এখানকার কিছুতেই হস্তক্ষেপ করিতে চাহি না, তাহাতে ভালো হইবে না। তুমি দেবী, তুমি যাহা ভালো বোধ করা, তাহাই