পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8S br রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়ো । আমি চলিলাম।” ঠাকুরপো, শুনিয়া যাও। তুমি চলিয়া গেলে কাহারও ভালো হইবে না। ইহার পরে আমাকে দোষ দিয়ে না।” বিহারী চলিয়া গেল। মহেন্দ্ৰ স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া ছিল। বিনোদিনী তাহার প্রতি জ্বলন্ত বজের মতো একটা কঠোর কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল। সে-ঘরে আশা একান্ত লজায় সংকোচে মরিয়া যাইতেছিল। বিহারী তাহাকে ভালোবাসে, এ কথা মহেন্দ্রের মুখে শুনিয়া সে আর মুখ তুলিতে পারিতেছিল না। কিন্তু তাহার উপর বিনোদিনীর আর দয়া হইল না। আশা যদি তখন চোখ তুলিয়া চাহিত, তাহা হইলে সে ভয় পাইত । সমস্ত সংসারের উপর বিনোদিনীর যেন খুন চাপিয়া গেছে । মিথ্যা কথা বটে ! বিনোদিনীকে কেহই ভালোবাসে না বটে ! সকলেই ভালোবাসে এই লজাবতী ননির পুতুলটিকে । মহেন্দ্ৰ সেই যে আবেগের মুখে বিহারীকে বলিয়াছিল, “আমি পাষণ্ড — তাহার পর আবেগ শান্তির পর হইতে সেই হঠাৎ আত্মপ্রকাশের জন্য সে বিহারীর কাছে কুষ্ঠিত হইয়া ছিল। সে মনে করিতেছিল, তাহার সব কথাই যেন ব্যক্ত হইয়া গেছে। সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না, অথচ বিহারী জানিয়াছে যে সে ভালোবাসে-—— ইহাতে বিহারীর উপরে তাহার বড়ো একটা বিরক্তি জন্মিতেছিল। বিশেষত, তাহার পর হইতে যতবার বিহারী তাহার সম্মুখে আসিতেছিল তাহার মনে হইতেছিল, যেন বিহারী সকৌতুহলে তাহার একটা ভিতরকার কথা খুজিয়া বেড়াইতেছে। সেই-সমস্ত বিরক্তি উত্তরোত্তর জমিতেছিল-- আজ একটু আঘাতেই বাহির হইয়া পড়িল । কিন্তু বিনোদিনী পাশের ঘর হইতে যেরূপ ব্যাকুলভাবে ছুটিয়া আসিল, যেরূপ আর্তকণ্ঠে বিহারীকে রাখিতে চেষ্টা করিল এবং বিহারীর আদেশ পালন স্বরূপে আশার সহিত কাশী যাইতে প্ৰস্তুত হইল, ইহা মহেন্দ্রের পক্ষে অভাবিতপূর্ব। এই দৃশ্যটি মহেন্দ্ৰকে প্রবল আঘাতে অভিভূত করিয়া দিল। সে বলিয়াছিল, সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না ; কিন্তু যাহা শুনিল, যাহা দেখিল, তাহা তাহাকে সুস্থির হইতে দিল না, তাহাকে চারি দিক হইতে বিচিত্র আকারে পীড়ন করিতে লাগিল। আর কেবলই নিৰ্ম্মফল পরিতাপের সহিত মনে হইতে লাগিল, “বিনোদিনী শুনিয়াছে— আমি বলিয়াছি আমি তাহাকে ভালোবাসি না” । 8 ܓ মহেন্দ্ৰ ভাবিতে লাগিল, “আমি বলিয়াছি মিথ্যা কথা, আমি বিনোদিনীকে ভালোবাসি না । অত্যন্ত কঠিন করিয়া বলিয়াছি । আমি যে তাহাকে ভালোবাসি তাহা না-ই হইল, কিন্তু ভালোবাসি না, এ কথাটা বড়ো কঠোর। এ কথায় আঘাত না পায় এমন স্ত্রীলোক কে আছে। ইহার প্রতিবাদ করিবার অবসর কবে কোথায় পাইব । ভালোবাসি এ কথা ঠিক বলা যায় না ; কিন্তু ভালোবাসি না, এই কথাটাকে একটু ফিকা করিয়া, নরম করিয়া জানানো দরকার। বিনোদিনীর মনে এমন-একটা নিষ্ঠুর অথচ ভুল সংস্কার থাকিতে দেওয়া অন্যায় ।” এই বলিয়া মহেন্দ্ৰ তাহার বাক্সর মধ্য হইতে আর-একবার তাহার চিঠি তিনখানি পড়িল। মনে মনে কহিল, “বিনোদিনী আমাকে যে ভালোবাসে, ইহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কাল সে বিহারীর কাছে । আমন করিয়া আসিয়া পড়িল কেন । সে কেবল আমাকে দেখাইয়া । আমি যখন তাহাকে ভালোবাসি না। স্পষ্ট করিয়া বলিলাম, তখন সে কোনো সুযোগে আমার কাছে তাহার ভালোবাসা প্ৰত্যাখ্যান না করিয়া কী করিবে । এমনি করিয়া আমার কাছে অবমানিত হইয়া হয়তো সে বিহারীকে ভালোবাসিতেও পারে ।” মহেন্দ্রের ক্ষোভ এতই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল যে, নিজের চাঞ্চল্যে সে নিজে আশ্চর্য এবং ভীত