পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 ○> মহেন্দ্ৰ ছোটাে চিঠিখানা খুলিয়া পড়িল। তাহা সরল ভাষায় লেখা, সেইজন্য অকৃত্ৰিম উদবেগ তাহার মধ্য হইতে পরিষ্কার প্রকাশ পাইয়াছে। চিঠিখানা পুনঃপুন পাঠ করিয়া এবং অনেক চিন্তা করিয়া মহেন্দ্ৰ ভাবিয়া উঠিতে পারিল না, বিনোদিনীর মনের গতি কোন দিকে। তাহার কেবলই আশঙ্কা হইতে লাগিল, “আমি যে তাহাকে ভালোবাসি না বলিয়া আপমান করিয়াছি, সেই অভিমানেই বিনোদিনী অন্য দিকে মন দিবার চেষ্টা করিতেছে । রাগ করিয়া আমার আশা সে একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছে ।” এই কথা মনে করিয়া মহেন্দ্রের ধৈর্যরক্ষা করা একেবারে অসম্ভব হইয়া উঠিল। যে-বিনোদিনী তাহার নিকট আত্মসমৰ্পণ করিতে আসিয়াছিল, সে যে মুহুর্তকালের মৃঢ়তায় সম্পূৰ্ণ তাহার অধিকারচ্যুত হইয়া যাইবে, সেই সম্ভাবনায় মহেন্দ্ৰকে স্থির থাকিতে দিল না। মহেন্দ্ৰ ভাবিল, “বিনোদিনী আমাকে যদি মনে মনে ভালোবাসে, তাহা বিনোদিনীর পক্ষে মঙ্গলকর- এক জায়গায় সে বদ্ধ হইয়া থাকিবে । আমি নিজের মন জানি, আমি তো তাহার প্রতি কখনোই অন্যায় করিব না। সে আমাকে নিরাপদে ভালোবাসিতে পারে। আমি আশাকে ভালোবাসি, আমার দ্বারা তাহার কোনো ভয় নাই। কিন্তু সে যদি অন্য কোনো দিকে মন দেয়। তবে তাহার কী সর্বনাশ হইতে পারে কে জানে।” মহেন্দ্ৰ স্থির করিল, নিজেকে ধরা না দিয়া বিনোদিনীর মন কোনো অবকাশে আর-একবার ফিরাইতেই হইবে । মহেন্দ্ৰ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেই দেখিল, বিনোদিনী পথের মধ্যেই যেন কাহার জন্য উৎকণ্ঠিত হইয়া প্ৰতীক্ষা করিতেছে। আমনি মহেন্দ্রের মনে চকিতের মধ্যে বিদ্বেষ জুলিয়া উঠিল। কহিল, “ওগো, মিথ্যা দাড়াইয়া আছ, দেখা পাইবে না। এই তোমার চিঠি ফিরিয়া আসিয়াছে।” বলিয়া চিঠিখানা ফেলিয়া দিল । বিনোদিনী কহিল, “ খোলা যে ?” মহেন্দ্ৰ তাহার জবাব না দিয়াই চলিয়া গেল। বিহারী চিঠি খুলিয়া পড়িয়া কোনো উত্তর না দিয়া চিঠি ফেরত পাঠাইয়াছে মনে করিয়া বিনোদিনীর সর্বাঙ্গের সমস্ত শিরা দব দািব করিতে লাগিল। যে দারোয়ান চিঠি লইয়া গিয়াছিল, তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইল ; সে অন্য কাজে অনুপস্থিত ছিল, তাহাকে পাওয়া গেল না। প্ৰদীপের মুখ হইতে যেমন জ্বলন্ত তৈলবিন্দ ক্ষরিয়া পড়ে, রুদ্ধ শয়নকক্ষের মধ্যে বিনোদিনীর দীপ্ত নেত্ৰ হইতে তেমনি হৃদয়ের জ্বালা অশ্রুজিলে গলিয়া পড়িতে লাগিল। নিজের চিঠিখানা ছিডিয়া ছিড়িয়া কুটিকুটি করিয়া কিছুতেই তাহার সাস্তুনা হইল না।-- সেই দুই-চারি লাইন কালির দাগকে অতীত হইতে বর্তমান হইতে একেবারেই মুছিয়া ফেলিবার, একেবারেই ‘না করিয়া দিবার কোনো উপায় নাই কেন । ক্রুদ্ধা মধুকরা যাহাকে সম্মুখে পায় তাহাকেই দংশন করে, ক্ষুব্ধ বিনোদিনী তেমনি তাহার চারি দিকের সমস্ত সংসারটাকে জ্বালাইবার জন্য প্ৰস্তুত হইল। সে যাহা চায় তাহাতেই বাধা ? কোনো কিছুতেই কি সে কৃতকার্য হইতে পরিবে না। সুখ যদি না পাইল, তবে যাহারা তাহার সকল সুখের অন্তরায়, যাহারা তাহাকে কৃতাৰ্থত হইতে ভ্ৰষ্ট, সমস্ত সম্ভবপর সম্পদ হইতে, বঞ্চিত করিয়াছে, তাহাদিগকে পরাস্ত ধূলিলুষ্ঠিত করিলেই তাহার ব্যর্থ জীবনের কর্ম সমাধা হইবে। ગ 6 সেদিন নুতন ফাঙ্গুনে প্রথম বসন্তের হাওয়া দিতেই আশা অনেক দিন পরে সন্ধ্যার আরম্ভে ছাদে মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে। একখানি মাসিক কাগজ লইয়া খণ্ডশ প্রকাশিত একটা গল্প খুব মনোযোগ দিয়া সেই অল্প আলোকে পড়িতেছিল। গল্পের নায়ক তখন সংবৎসর পরে পূজার ছুটিতে বাড়ি আসিবার সময় ডাকাতের হাতে পড়িয়াছে, আশার হৃদয় উদবেগে। কঁাপিতেছিল ; এ দিকে হতভাগিনী নায়িকা ঠিক সেই সময়েই বিপদের স্বপ্ন দেখিয়া কাদিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে। আশা চোখের জল আর রাখিতে পারে না। আশা বাংলা গল্পের অত্যন্ত উদার সমালোচক ছিল। যাহা পড়িত, তাহাই মনে হইত চমৎকার। বিনোদিনীকে ডাকিয়া বলিত, “ভাই চোখের বালি, মাথা খাও, এ গল্পটা পড়িয়া দেখো ।