পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8\OVO উঠিয়া চলিয়া গেল। তখন কোথায় রহিল মাসিক পত্রের সেই গল্পের নায়ক, কোথায় রহিল গল্পের নায়িকা। সূর্যাস্তের আভা অন্ধকারে মিশাইয়া গেল, সন্ধ্যারম্ভের ক্ষণিক বসন্তের বাতাস গিয়া শীতের হাওয়া দিতে লাগিল— তখনো আশা সেই মাদুরের উপর লুষ্ঠিত হইয়া পড়িয়া রহিল। অনেক রাত্রে আশা শয়নঘরে গিয়া দেখিল, মহেন্দ্ৰ তাহাকে না ডাকিয়াই শুইয়া পডিয়াছে। মনে ঘূণা করিতেছে। বিছানার মধ্যে ঢুকিয়াই আশা মহেন্দ্রের দুই পা জড়াইয়া তাহার পায়ের উপর মুখ রাখিয়া পড়িয়া রহিল। তখন মহেন্দ্র করুণায় বিচলিত হইয়া তাহাকে টানিয়া লইবার চেষ্টা করিল। আশা কিছুতেই উঠিল না। সে কহিল, “আমি যদি কোনো দোষ করিয়া থাকি, আমাকে মাপ করো।” মহেন্দ্ৰ আদ্ৰচিত্তে কহিল, “তোমার কোনো দোষ নাই, চুনি। আমি নিতান্ত পাষণ্ড, তাই তোমাকে অকারণে আঘাত করিয়াছি।” তখন মহেন্দ্রের দুই পা অভিষিক্ত করিয়া আশার অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্ৰ উঠিয়া বসিয়া তাহাকে দুই বাহুতে তুলিয়া আপনার পাশে শোয়াইল। আশার রোদন্নবেগ থামিলে সে কহিল, “মাসিকে কি আমার দেখিতে যাইবার ইচ্ছা করে না। কিন্তু তোমাকে ফেলিয়া আমার যাইতে মন সরে না। তাই আমি যাইতে চাই নাই, তুমি রাগ করিয়ো না।” মহেন্দ্ৰ ধীরে ধীরে আশার আদ্ৰ কপোল মুছাইতে মুছাইতে কহিল, “এ কি রাগ করিবার কথা, চুনি। আমাকে ছাডিয়া যাইতে পার না, সে লইয়া আমি রাগ করিব ? তোমাকে কোথাও যাইতে হইবে না ।” আশা কহিল, “না, আমি কাশী যাইব ।” মহেন্দ্ৰ । কেন । আশা । তোমাকে মনে মনে সন্দেহ করিয়া যাইতেছি না- এ কথা যখন একবার তোমার মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে, তখন আমাকে কিছুদিনের জন্যও যাইতেই হইবে। মহেন্দ্র । আমি পাপ করিলাম, তাহার। প্ৰায়শ্চিত্ত তোমাকে করিতে হইবে ? আশা । তাহা আমি জানি না- কিন্তু পাপ আমার কোনোখানে হইয়াছেই, নহিলে এমন-সকল অসম্ভব কথা উঠিতেই পারিত না । যে-সব কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিতে পারিতাম না, সে-সব কথা কেন শুনিতে হইতেছে । মহেন্দ্র । তাহার কারণ, আমি যে কী মন্দ লোক তাহা তোমার স্বপ্নেরও অগোচর । আশা ব্যস্ত হইয়া কহিল, “আবার ! ও কথা বলিয়ো না। কিন্তু এবার আমি কাশী যাইবই।” মহেন্দ্ৰ হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা যাও, কিন্তু তোমার চোখের আড়ালে আমি যদি নষ্ট হইয়া যাই, তাহা হইলে কী হইবে।” । আশা কহিল, “ তোমার আর আত ভয় দেখাইতে হইবে না, আমি কিনা ভাবিয়া অস্থির হইতেছি ?” মহেন্দ্ৰ। কিন্তু ভাবা উচিত । তোমার এমন স্বামীটিকে যদি অসাবধানে বিগড়াইতে দাও, তবে এর পরে কাহাকে দোষ দিবে ? আশা । তোমাকে দোষ দিব না, সেজন্য তুমি ভাবিয়ো না। মহেন্দ্র । তখন নিজের দোষ স্বীকার করিবে ? আশা | একশোবার । মহেন্দ্ৰ। আচ্ছা, তাহা হইলে কাল একবার তোমার জেঠামশায়ের সঙ্গে গিয়া কথাবার্তা ঠিক করিয়া আসিব । এই বলিয়া মহেন্দ্র ‘অনেক রাত হইয়াছে’ বলিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল । কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ পুনর্বার এ পাশে ফিরিয়া কহিল,“চুনি, কাজ নাই, তুমি নাই-বা গেলে ।” আশা কাতর হইয়া কহিল, “আবার বারণ করিতেছ। কেন । এবার একবার না গেলে তোমার সেই ভৎসনাটা আমার গায়ে লাগিয়া থাকিবে। আমাকে দু-চার দিনের জন্যও পাঠাইয়া দাও।” Nd || || NR br