পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 SD (? সমাজে তিনি মহেন্দ্র ছাড়া আর কিছুই জানিতেন না। মহেন্দ্র সম্বন্ধে বিনোদিনী সমাজনিন্দার আভাস দেওয়াতে তিনি বিরক্ত হইয়াছিলেন । আজন্মকাল তিনি মহিনীকে দেখিয়া আসিতেছেন, তাহার মতো এমন ভালো ছেলে আছে কোথায় । সেই মহিনের সম্বন্ধেও নিন্দা ! যদি কেহ করে, তবে তাহার জিহবা খসিয়া যাক । তাহার নিজের কাছে যেটা ভালো লাগে ও ভালো বোধ হয় সে-সম্বন্ধে বিশ্বের লোককে উপেক্ষা করিবার জন্য রাজলক্ষ্মীর একটা স্বাভাবিক জেদ ছিল । আজি মহেন্দ্ৰ কালেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া আপনার শয়নঘর দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। দ্বার খুলিয়াই দেখিল, চন্দনগুড়া ও ধুনীর গন্ধে ঘর আমোদিত হইয়া আছে। মশারিতে গোলাপি রেশমের ঝালর লাগানো। নীচের বিছানায় শুভ্ৰ জাজিম তকতক করিতেছে এবং তাহার উপরে পূর্বেকার কারুকার্য বিনোদিনীর বহুদিনের পরিশ্রমজাত। আশা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিত, “এগুলি তুই কার জন্যে তৈরি করিতেছিস, ভাই ।” বিনোদিনী হাসিয়া বলিত, “আমার চিতাশয্যার জন্য। মরণ ছাড়া তো সোহাগের লোক আমার আর কেহই নাই ।” দেয়ালে মহেন্দ্রের যে বাধানো ফোটোগ্রাফ খানি ছিল, তাহার ফ্রেমের চার কোণে রঙিন ফিতার দ্বারা সুনিপুণভাবে চারিটি গ্রস্থি বাধা, এবং সেই ছবির নীচে ভিত্তিগাত্রে একটি টিপাইয়ের দুই ধারে দুই ফুলদানিতে ফুলের তোড়া, যেন মহেন্দ্রের প্রতিমূর্তি কোনো অজ্ঞাত ভক্তের পূজা প্রাপ্ত হইয়াছে। সবসুদ্ধ সমস্ত ঘরের চেহারা অন্যরকম। খাট যেখানে ছিল সেখান হইতে একটুখানি সরানো। ঘরটিকে দুই ভাগ করা হইয়াছে; খাটের সম্মুখে দুটি বড়ো আলনায় কাপড় ঝুলাইয়া দিয়া আড়ালের মতো প্ৰস্তুত হওয়ায় নীচে বসিবার বিছানা ও রাত্ৰে শুইবার খাটি স্বতন্ত্র হইয়া গেছে। যে আলমারিতে আশার সমস্ত শখের জিনিস চীনের খেলনা প্রভৃতি সাজানো ছিল, সেই রির কাচের দরজায় ভিতরের গায়ে লাল সালু কুঞ্চিত করিয়া মারিয়া দেওয়া হইয়াছে; এখন আর তাহার ভিতরের কোনো জিনিস দেখা যায় না। ঘরের মধ্যে তাহার পূর্ব-ইতিহাসের যে-কিছু চিহ্ন ছিল, তাহা নূতন হস্তের নব সজায় সম্পূৰ্ণ আচ্ছন্ন হইয়া গেছে। পরিশ্রান্ত মহেন্দ্ৰ মেঝের উপরকার শুভ্ৰ বিছানায় শুইয়া নূতন বালিশগুলির উপর মাথা রাখিবামাত্র একটি মৃদু সুগন্ধ অনুভব করিল— বালিশের ভিতরকার তুলার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে নাগকেশর ফুলের রেণু ও কিছু আতর মিশ্রিত ছিল। মহেন্দ্রের চোখ বুজিয়া আসিল, মনে হইতে লাগিল, এই বালিশের উপর যাহার নিপুণ হস্তের শিল্প, তাহারই কোমল চম্পক-অঙ্গুলির যেন গন্ধ পাওয়া যাইতেছে। এমন সময় দাসী রুপার রেকাবিতে ফল ও মিষ্ট এবং কাচের গ্রাসে বরফ-দেওয়া আনারসের শরবত আনিয়া দিল। এ-সমস্তই পূর্বপ্রথা হইতে কিছু বিভিন্ন এবং বহু যত্ন ও পারিপাট্যের সহিত তৃপ্তিপূর্বক ভোজন সমাধা হইলে, রুপার বাটায় পান ও মসলা লইয়া বিনোদিনী ধীরে ধীরে ঘরে মাপ করিয়ো, ঠাকুরপো। আর যাই কর, আমার মাথার দিব্য রহিল, তোমার অন্যত্ব হইতেছে, এ খবরটা আমার চোখের বালিকে দিয়ে না। আমার যথাসাধ্য আমি করিতেছি— কিন্তু কী করিব ভাই, সংসারের সমস্ত কাজই আমার ঘাড়ে।” এই বলিয়া বিনোদিনী পানের বাটা মহেন্দ্রের সম্মুখে অগ্রসর করিয়া দিল। আজিকার পানের মধ্যেও কেয়া খয়েরের একটু বিশেষ নূতন গন্ধ পাওয়া গেল। মহেন্দ্ৰ কহিল, “যত্বের মাঝে মাঝে এমন এক-একটা ক্ৰটি থাকাই ভালো।” বিনোদিনী কহিল, “ভালো কেন, শুনি ।” মহেন্দ্ৰ উত্তর করিল, “তার পরে খোটা দিয়া সুন্দসুদ্ধ আদায় করা যায়।” “মহাজন-মহাশয়, সুন্দ কত জমিল ?”