পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 88C মহেন্দ্রের কত উপকার করিয়াছে, তাহার জন্য কতবার কত কষ্ট সহ্য করিয়াছে, সে সমস্ত তিনি বিনোদিনীর কাছে বিবৃত করিয়া বলিতে লাগিলেন— ছেলের উপর তাহার নিজের যা নালিশ তা বিহারীর বিবরণ দ্বারা সমর্থন করিতে লাগিলেন। দুদিন বউকে পাইয়া মহেন্দ্ৰ যদি তাহার চিরকালের বন্ধুকে এমন অনাদর করে, তবে সংসারে ন্যায়ধর্ম আর রহিল কোথায়। বিনোদিনী কহিল, “কাল রবিবার আছে, তুমি বিহারী-ঠাকুরপোকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া খাওয়াও, তিনি খুশি হইবেন।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ঠিক বলিয়াছ বউ, তা হইলে মহিনকে ডাকাই, সে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইবে।” বিনোদিনী । না পিসিমা, তুমি নিজে নিমন্ত্রণ করো। রাজলক্ষ্মী। আমি কি তোমাদের মতো লিখিতে পড়িতে জানি। বিনোদিনী । তা হোক, তোমার হইয়া নাহয় আমিই লিখিয়া দিতেছি। বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর নাম দিয়া নিজেই নিমন্ত্রণ-চিঠি লিখিয়া পাঠাইল । রবিবার দিন মহেন্দ্রের অত্যন্ত আগ্রহের দিন। পূর্বরাত্ৰি হইতেই তাহার কল্পনা উদ্দাম হইয়া থাকে, যদিও এ পর্যন্ত তাহার কল্পনার অনুরূপ কিছুই হয় নাই- তবু রবিবারের ভোরের আলো তাহার চক্ষে মধুকৰ্ষণ করিতে লাগিল। জাগ্ৰত নগরীর সমস্ত কোলাহল তাহার কানে অপরূপ সংগীতের মতো আসিয়া প্ৰবেশ করিল। কিন্তু ব্যাপারখানা কী । মার আজ কোনো ব্ৰত আছে নাকি ! অন্যদিনের মতো বিনোদিনীর প্রতি গৃহকর্মের ভার দিয়া তিনি তো বিশ্রাম করিতেছেন না। আজ তিনি নিজেই ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতেছেন । এই হাঙ্গামে দশটা বাজিয়া গেল— ইতিমধ্যে মহেন্দ্ৰ কোনো ছুতায় বিনোদিনীর সঙ্গে এক মুহূর্ত বিরলে দেখা করিতে পারিল না। বই পড়িতে চেষ্টা করিল, পড়ায় কিছুতেই মন বসিল না— খবরের কাগজের একটা অনাবশ্যক বিজ্ঞাপনে পনেরো মিনিট দৃষ্টি আবদ্ধ হইয়া রহিল। আর থাকিতে পারিল না। নীচে গিয়া দেখিল, মা তাহার ঘরের বারান্দায় একটা তোলা। উনানে রাধিতেছেন এবং বিনোদিনী কটিদেশে দৃঢ় করিয়া আঁচল জড়াইয়া জোগান দিতে ব্যস্ত। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “আজ তোমাদের ব্যাপারটা কী। এত ধুমধাম যে !” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বাউ তোমাকে বলে নাই ? আজি যে বিহারীকে নিমন্ত্ৰণ করিয়াছি।” বিহারীকে নিমন্ত্রণ ! মহেন্দ্রের সর্বশরীর জ্বলিয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ কহিল, “কিন্তু মা, আমি তো থাকিতে পারিব না।” রাজলক্ষ্মী । কেন। মহেন্দ্র । আমার যে বাহিরে যাইতে হইবে । রাজলক্ষ্মী । খাওয়াদাওয়া করিয়া যাস, বেশি দেরি হইবে না । মহেন্দ্ৰ | আমার যে বাহিরে নিমন্ত্রণ আছে । বিনোদিনী মুহুর্তের জন্য মহেন্দ্রের মুখে কটাক্ষপাত করিয়া কহিল, “যদি নিমন্ত্রণ থাকে, তা হইলে উনি যান-না, পিসিমা । নাহয় আজ বিহারী-ঠাকুরপো ।একলাই খাইবেন।” কিন্তু নিজের হাতের যত্নের রান্না মহিনকে খাওয়াইতে পরিবেন না, ইহা রাজলক্ষ্মীর সহিবে কেন । তিনি যতই পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন, মহিন ততই বাকিয়া দাড়াইল। “অত্যন্ত জরুরি নিমন্ত্রণ, কিছুতেই কাটাইবার জো নাই— বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিবার পূর্বে আমার সহিত পরামর্শ করা উচিত ছিল’ ইত্যাদি। রাগ করিয়া মহেন্দ্ৰ। এইরূপে মাকে শাস্তি দিবার ব্যবস্থা করিল। রাজলক্ষ্মীর সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল। তাহার ইচ্ছা হইল, রান্না ফেলিয়া তিনি চলিয়া যান। বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, তুমি কিছু ভাবিয়ো না— ঠাকুরপো মুখে আস্ফালন করিতেছেন, কিন্তু আজ উহার বাহিরে নিমন্ত্রণে যাওয়া হইতেছে না।”