পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রাজলক্ষ্মী মাথা নাডিয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি মহিনকে জান না, ও যা একবার ধরে তা কিছুতেই ছাড়ে না।” p কিন্তু বিনোদিনী মহেন্দ্ৰকে রাজলক্ষ্মীর চেয়ে কম জানে না, তাহাই প্ৰমাণ হইল। মহেন্দ্ৰ বুঝিয়াছিল, বিহারীকে বিনোদিনীই নিমন্ত্রণ করাইয়াছে। ইহাতে তাহার হৃদয় ঈর্ষায় যতই পীড়িত হইতে লাগিল, ততই তাহার পক্ষে দূরে যাওয়া কঠিন হইল। বিহারী কী করে, বিনোদিনী কী করে, তাহা না দেখিয়া সে বাচিবে কী করিয়া। দেখিয়া জ্বলিতে হইবে, কিন্তু দেখাও চাই । বিহারী আজ অনেক দিন পরে নিমন্ত্রিত-আত্মীয়ভাবে মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। বাল্যকাল হইতে যে ঘর তাহার পরিচিত এবং যেখানে সে ঘরের ছেলের মতো অবারিতভাবে প্ৰবেশ করিয়া দৌরাত্ম্য করিয়াছে, তাহার দ্বারের কাছে আসিয়া মুহুর্তের জন্য সে থমকিয়া দাড়াইল— একটা আঘাত সংবরণ করিয়া লইয়া সে স্মিতহাস্যে ঘরে প্রবেশ করিয়া সদ্যঃস্মাতা রাজলক্ষ্মীকে প্ৰণাম করিয়া তাহার পায়ের ধূলা লইল। বিহারী যখন সর্বদা যাতায়াত করিত তখন এরূপ অভিবাদন তাহদের প্রথা ছিল না। আজ যেন সে বহুদূর প্রবাস হইতে পুনর্বার ঘরে ফিরিয়া আসিল। বিহারী প্ৰণাম করিয়া উঠিবার সময় রাজলক্ষ্মী সস্নেহে তাহাব মাথায় হস্তম্পর্শ করিলেন। রাজলক্ষ্মী আজ নিগৃঢ় সহানুভূতিবশত বিহারীর প্রতি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি আদর ও স্নেহ প্ৰকাশ করিলেন। কহিলেন, “ও বেহারি, তুই এতদিন আসিস নাই কেন । আমি রোজ মনে করিতাম, আজি নিশ্চয় বেহাবি আসিবে, কিন্তু তোর আর দেখা নাই।” বিহারী হাসিয়া কহিল, “ রোজ আসিলে তো তোমার বিহারীকে রোজ মনে করিতে না, মা ! রাজলক্ষ্মী বিমর্ষ হইয়া কহিলেন, “মহিনের আজ কোথায় নিমন্ত্রণ আছে, সে আজ কিছুতেই থাকিতে পারিল না ।” শুনিবা মাত্ৰ বিহারীর মনটা বিকল হইয়া গেল। আশৈশব প্ৰণয়ের শেষ এই পরিণাম ? একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মন হইতে সমস্ত বিষাদ বাষ্প উপস্থিতমত তাড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “আজি কী রান্না হইয়াছে শুনি ৷” বলিয়া তাহার নিজের প্ৰিয় ব্যঞ্জনগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মীর রন্ধনের দিন বিহারী কিছু অতিরিক্ত আড়ম্বর করিয়া নিজেকে লুব্ধ বলিয়া পরিচয় দিত- আহারালোলুপতা দেখাইয়া বিহারী মাতৃহৃদয়াশালিনী রাজলক্ষ্মীর স্নেহ কাড়িয়া লইত। আজও তাহার স্বরচিত ব্যঞ্জন সম্বন্ধে বিহারীর অতিমাত্রায় কৌতুহল দেখিয়া, রাজলক্ষ্মী হাসিতে হাসিতে তাহার লোভাতুর অতিথিকে আশ্বাস দিলেন। এমন সময় মহেন্দ্ৰ আসিয়া বিহারীকে শুষ্ক স্বরে দস্তুরমত জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিহারী, কেমন আছি।” রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কই মহিন, তুই তোর নিমন্ত্রণে গেলি না ?” - মহেন্দ্ৰ লাজ ঢাকিতে চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, সেটা কাটাইয়া দেওয়া গেছে।” স্নান করিয়া আসিয়া বিনােদিনী যখন দেখা দিল, তখন বিহারী প্রথমটা কিছুই বলিতে পারিল না। বিনোদিনী ও মহেন্দ্রের যে-দৃশ্য সে দেখিয়াছিল, তাহা তাহার মনে মুদ্রিত ছিল। দুদিনী বিহারীর অনতিদূরে আসিয়া মৃদুস্তরে কহিল, "কী ঠাকুরপাে, একেবারে চিনতেই পার • יין বিহারী কহিল, “সকলকেই কি চেনা যায়।” বিনোদিনী কহিল, “একটু বিবেচনা থাকিলেই যায়।” বলিয়া খবর দিল, “পিসিমা, খাবার প্রস্তুত হইয়াছে।” মহেন্দ্ৰ-বিহারী খাইতে বসিল ; রাজলক্ষ্মী অদূরে বসিয়া দেখিতে লাগিলেন এবং বিনোদিনী পরিবেশন করিতে লাগিল ।